গোবিন্দ আমাকে দেখে হৈ হৈ করে উঠলো।
আসুন, আসুন স্যার। ওরে, চেয়ারটা মুছে দে। বলতে বলতে সে নিজেই একটা চেয়ার বেশ ঘষে মুছে দিল। হেসে জিগ্যেস করল, কেমন আছেন? অনেকদিন এদিকে আসেন না। অ্যাডভোকেট হয়েছেন শুনলাম?
বললাম, ভুলে যাইনি বলেই তো এলাম। তোমার দোকানটা যে কে সেই রয়ে গেল গোবিন্দ। চলে যায় স্যার। কী খাবেন? মুরগি পাউরুটি? না ওমলেট?
দাও, তোমার বেস্ট যা আছে। মনে আছে, আমি ঠাট্টা করে বলতাম এটা আমাদের লিটল শাহবাগ।
হেঁ হেঁ করে হাসল গোবিন্দ। তার কোকড়ানো বাবড়ি চুলে হাতের পিঠ ঘষলো অনাবশ্যক ভাবে একবার। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে দরোজার মুখে কয়লার চুলোয় চাপানো ডেকচির ঢাকনাটা তুলল। আমি ভেতরে গেলাম।
যাদের আশা করেছিলাম, সবাই আছে। আমার তাসের পুরনো বন্ধুরা এবং নতুন আরো দুটি মুখ। পুরনোরা আমাকে দেখে প্রথমে বোকা হয়ে গেল। আর তাদের অবাক হওয়া দেখে নতুনেরা তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে লাগল আমাকে।
আমার বেশ ভালোভাবেই মনে আছে, আমিও অবাক হয়েছিলাম ওদের সেই একই টেবিলে এই দীর্ঘদিন পরেও একই ভাবে গোল হয়ে বসে থাকতে দেখে। তাসের প্যাকেটটা তেমনি পড়ে আছে পাশে, হাতগুলো উদ্যত এবং স্থির। যেন আমার উঠে যাওয়া আর আজ ফিরে আসার মধ্যে মাত্র কয়েক মিনিট কাল অতিবাহিত হয়েছে; আমি বেরিয়ে গিয়ে ঐ কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তিন বৎসর পরিক্রমা করে এসেছি–তিন বৎসর।–নিশাত, ভালোবাসা, বিয়ের কথা, মা, আমার বাবার মৃত্যুর ইতিহাস। তফাৎটা কেবল এখানে, আগে আমি ছিলাম গোবিন্দর ভিনিগারের শিশির মতো ফালতু, আর আজ ওরা আমাকে দেখছে মুগ্ধ চোখে, ঈর্ষার কাঁচের ভেতরে দিয়ে; যেন রাজার সঙ্গে দেখা করে গাঁয়ের মানুষ আবার গাঁয়ে ফিরে এসেছে।
লোকমান টেবিলে চাপড় দিয়ে বলে উঠল, বাই জোভ, কে এসেছে ভাঙা ঘরে?
আসাদ বলল, বেশ যাহোক আপনি। একেবারে লাপাত্তা। একবার তো আসতে হয়, নাকি? তাইতো এলাম।
আরো দুহাত খেলল ওরা! আমি বসে বসে দেখলাম। একবার একটা তর্ক হলো তাস নিয়ে। আমাকে তার সালিশী করতে হলো। গোবিন্দ মুবগি পাউরুটি এনে দিল। পর পর দুকাপ চা খেলাম আমি।
ওরা উঠে দাঁড়াল। আমি বললাম, এত সকালে কোথায়?
তখন এ-ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করল ওরা। বিধাটা কোথায় বুঝতে পারলাম না। অবশেষে লোকমান বলল, যাবেন আপনি?
কোথায়?
যেখানে যাচ্ছি।
সবাই যাচ্ছে?
হ্যাঁ, আগে থেকেই ঠিক হয়েছিল। চলুন মন্দ হবে না।
আমি ভেবেছিলাম, সিনেমা। বললাম, বেশ তো।
বেরুনো গেল ওদের সঙ্গে।
সে রাতে আমি প্রথম মদ্যপান করি। খারাপ লাগছিল বেশ, কিন্তু ওয়াক-থু করিনি। বরং আমার বেশ স্ফুর্তি করছিল ভেবে যে এতকাল শুনেই এসেছি, জিনিসটার স্বাদ নেওয়া গেল। নেহাৎ মন্দও নয়। গলা পুড়তে পুড়তে ভেতরে নেমে যায়, পাকস্থলীতে গিয়ে ফণা তুলে বসে থাকে। তারপর মনে হয় মাথার পেছনে কে যেন মৃদু হাতে অবিরাম চাপড় দিচ্ছে–তার আরামে ভারী হালকা আর রঙিন হয়ে আসে মেজাজটা।
পরদিন আমি ওদের খাওয়ালাম। এবং তারপর থেকে নিয়মিত। ব্যাঙ্কে যে টাকাগুলো ছিল তার সঠিক অঙ্ক মনে থাকত না; মনে হতো আমি যদি কিছু নাও করি সারাজীবন আর এভাবে সারারাত ফ্লাস খেলে, মদ খেয়ে, হৈ হৈ করে কাটিয়ে সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমোই তো কোন অভাব হবে না কোনদিন।
নিশাতের কথা এখন আর মনে পড়ে না। আমার মনে হয় না এই এক বৎসরে নিশাতকে আমি ভাববার চেষ্টা আদৌ করেছি। একদা তাকে ভালোবাসঞ্জাম। সে ভালোবাসা সুদূর আর অবাস্তব মনে হতো এই দিনগুলোয়। যেন অন্য কারো জীবনে ওসব ঘটে গেছে, কিংবা আমার আরেক জীবনে। নিশাতের কোনো ছবি আমার কাছে ছিল না। আমার মনে হয়, যদি চোখ বুঝে দেখবার চেষ্টা করতাম তো দেখতে পেতাম না নিশাতকে। নিশাতের চেহারাই ভুলে গিয়েছিলাম আমি।
এই সময়ে একটা নতুন ভাবনা আমাকে পেয়ে বসেছিল। আমি ভাবতে চেষ্টা করতাম আমার বাবাকে। যে কোনো মুহূর্তে পেয়ে বসত এই ভাবনার রোখ। টের পেতাম, কেন্দ্রীভূত হয়ে আসছে আমার চোখ–কোনো বস্তু বা শূন্যের মধ্যে চোখ রেখে আমি কোন এক অদৃশ্য বলীয়ানের সঙ্গে লড়াই করতাম, যে শক্তিমানের কাছে গচ্ছিত রয়েছে আমার বাবার মুখ। যেন তাকে হারিয়ে দিতে পারলে, দৃষ্টির তীরে বিদ্ধ করতে পারলেই সব পেয়ে যাবো স্পষ্ট দেখতে পাবো বাবাকে।
একেকদিন তাস হাতে স্তব্ধ হয়ে যেতাম। তাসের টেক্কা হঠাৎ বিস্তৃততর হতে থাকতো আমার সমুখে। টেক্কার শরীরে দুর্বোধ্য কারুকাজের ভেতরে ছড়ানো ছিটানো দেখতে পেতাম–যুগলের অংশ, চিবুক, নাকের রেখা, ঠোঁট–ধাঁধার মতো, খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন; আমার সাধনা সেগুলো একত্রিত করে মিলিয়ে বাবার মুখ সৃষ্টি করা।
বন্ধু কেউ ধাক্কা দিলে ঘোরটা কেটে যেত। খুব অপ্রস্তুত হয়ে যেতাম। খেলা আর জমতো না।
এবারে আমার একটা উন্নতি লক্ষ করা গিয়েছিল। সে আমার কপাল খুলে গিয়েছে। আগে, নিশাতের আগে, যখন এই গোবিন্দর দোকানের পেছনে বসে খেলতাম, তখন হারতাম। যদিও বা জিততাম তো সেটা এমন কিছু বিস্ময়কর জিৎ হতো না। আর আজ ওরা আমাকে তাস বেঁটে দিতে বলে, কপাল তো তোমার। লাও দেখি কী হয়।
কী আবার হবে? গোবিন্দ যখন দোকান বন্ধ করছে বলে শেষবারের মতো তাগাদা করত, আর আমরা আরো এক হাত বলে আরো তিন চার হাত খেলে উঠতাম, তখন দেখা যেত আমার পকেটে লাভের কড়ি আসল উপচে উঠেছে। অবশ্যি, আমার মনটা ছিল খুব উদার এবং টাকাগুলোর সদ্ব্যবহার হতো মদের বোতলে, মাংসে, সিনেমায়, সিগারেটে। আজ মনে হয়, ওরা আমাকে ভালোবাসত। আমার সম্পর্কে একটা উচ্চ ধারণা ছিল ওদের। কিন্তু কী কারণে এই ভালোবাসা, আর কেনই বা এ উচ্চ ধারণা তা বলতে পারব না।