বড় ক্লান্ত লাগছিল তখন। আলাপকে সংক্ষিপ্ত করবার জন্যেই মিথ্যে করে বললাম, হ্যাঁ, অসুখ।
সে রাতে ওর ওখানে থেকে গেলাম।
পরদিন টেলিফোন করতে গিয়ে আমার হাত কাঁপল। যখন রিসিভারটা তুলে ডায়াল করতে গিয়েও রেখে দিলাম, কাজি সাহেব অবাক হয়ে আমাকে দেখলেন। নিঃশব্দে একটা প্রশ্ন আঁকলেন ভ্রূ তুলে।
আমি যে চমৎকার মিথ্যে বলতে পারব, আমার ধারণা ছিল না। বললাম, সময় জানতে চেয়েছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হলো আজ সকালেই ঘড়ি মিলিয়েছি, তাই রেখে দিলাম।
ও।
আরেকবার আড়চোখে দেখলাম কাজি সাহেবকে। কী জানি, তিনি যদি বুঝতে পেরে থাকেন, আমি মিথ্যে বলেছি। কিন্তু তিনি ততক্ষণে তার নথিপত্রে আবার ডুবে গেছেন। আমি বাঁচলাম।
নিশাতকে আর টেলিফোন করা হলো না।
৫. প্রথমে ছিল দ্বিধা
প্রথমে ছিল দ্বিধা। পরে এলো নিস্পৃহতা। সেদিন সন্ধ্যে সাতটায় নিশাতের সঙ্গে দেখা হবে, ও আমার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু আমি যাইনি। এই প্রথম ওকে কোনো কথা দিয়ে সে কথা রাখতে পারিনি। পরদিন টেলিফোনে যোগাযোগ করতে গিয়েও পারলাম না, দ্বিধা আমাকে থামিয়ে দিল। কাজি সাহেবের চেম্বার থেকে তারপর যখন শরীর খারাপ বলে বেবিয়ে এলাম তখন আমাকে জড়িয়ে ধরলো এক অবসাদ আর নিস্পৃহতা। মনে হলো, আমার ভাগ্যই হচ্ছে নিশাত থেকে দূরে থাক, আমার সমস্ত সুখের কবর হয়ে যাওয়া। তখন বড় অর্থহীন মনে হলো আমার বাড়ির স্বপ্ন, গাড়ি, শখ, ফুটফুটে একটি ছেলের কল্পনা। মনে হলো, এসব থেকে নিজেকে আমি যতক্ষণ না বঞ্চিত করছি ততক্ষণ পিতৃহত্যার দায় থেকে আমার মুক্তি নেই।
আমি নিজেকে সবকিছু থেকে একেবারে দূরে সরিয়ে দিলাম। এই অভিশপ্ত জীবন আমাকে যে একটা ধারণ করতে হবে। এখানে কেউ বন্ধু হতে পারবে না, অংশ নিতে পারবে না।
নিশাত আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করেছিল কিনা বলতে পারব না। করে থাকলেও আমার তা জানবার উপায় ছিল না। কারণ সে আমার ঐ ঠিকানাটাই জানতো–জালালের বাসার ঠিকানা; কিন্তু মার কাছ থেকে ফিরে আসবার পাঁচদিনের মধ্যেই আমি জালালের বাসা ছেড়ে চলে যাই। যাই মানে, যেতে হয়েছিল। আমার দেয়া সেন্ট, চপ্পল, শাড়ির বিশ্রী ব্যাখ্যা করেছিল জালাল। এবং একদিন আমার সামনেই সে তার স্ত্রীর হাত থেকে সেন্টের শিশিটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল ড্রেনে। সেদিনই আমি আমার বাক্স বিছানা গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসি। সেদিন আমার আরো দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে যায় যে আমার স্পর্শমাত্রই অমঙ্গল। এই পরিস্থিতিতে জালালের কাছে নতুন ঠিকানা রেখে আসার কথা কল্পনাও করা যায় না। তাই নিশাত যদি এখানে খোঁজ করেও থাকে আমি আর জানতে পারিনি।
আরেকটা হতে পারত, নিশাত যদি আমাকে টেলিফোন করত কাজি সাহেবের চেম্বারে। কিন্তু পরদিনই, ঐ টেলিফোন তুলে রেখে দেয়ার পর, পনেরো দিনের ছুটি নিই আমি। সেই পনেরো দিনে আমি এতটা বদলে গেলাম যে, মনে হলো ওকালতি আর করবো না। সেই কথা লিখে একটা পোস্টকার্ড কাজি সাহেবকে পাঠিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিলাম। তাকে লিখেছিলাম, আমি ঢাকাতেই থাকছি না। কাজেই নিশাত যদি এখানেও খোঁজ নিয়ে থাকে তো ব্যর্থ হয়েছে।
এখন মনে হয়, সত্যি নিশাত সেদিন কী ভেবেছিল তার জীবন থেকে আমার এই আকস্মিক অন্তর্ধানে। একথা তো সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। সে আমাকে ভালোবাসত এবং আমার ওপরে নির্ভর করে ছিল। আমি যে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে তাকে ভুলে যেতে পারব একথা সে বিশ্বাস করবে কী করে? সে নিশ্চয়ই মনে করেছে–আমি মরে গেছি, কী আমার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে, কী কেউ আমাকে বন্দি করে রেখেছে। হ্যাঁ, এইসব অসম্ভব অবাস্তব কারণ ছাড়া আর কী ইবা সে ভাবতে পারত?
কিন্তু আসলে যা সত্যি তা নিশাত তার দুঃস্বপ্নেও দেখতে পারবে না। সে কি কেঁদেছিল? তার রাত কি বিদ্রি হয়েছিল? তার শরীরে কি জীবন-রসের ধারা ক্ষীণ, ম্লান হয়ে গিয়েছিল?
আজ আমার মনে হয়, নিশাত যদি আমার খোঁজ পেত, তাহলে আমার জীবন আবার অন্যখাতে বইতো। তার সঙ্গে যদি একবার দেখা হয়ে যেত আমার, তাহলে আমি স্বাভাবিক হয়ে যেতাম। মনে হয়, আমাকে যেভাবেই হোক তার খুঁজে বার করা উচিত ছিল। কিন্তু, এ পৃথিবীতে কার দায় পড়েছে আমার চেতন বা অচেতন মনের ইচ্ছেগুলোর তোয়াক্কা করবার? মানুষ নিজেই তার নিজেকে তৈরি করে এবং সেখানে অন্য কারো দায় নেই।
নিশাতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক এভাবে চুকিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত যে কী করে নিতে পারলাম সেদিন। সাতদিন আগেও তো কত অসম্ভব মনে হতো বিচ্ছেদ। আজ আমার সাকুল্যে এই ধারণা হয়েছে, মানুষ আবিষ্কার করতে পারে মহাদেশ, পর্বত, নক্ষত্র; জয় করতে পারে যুদ্ধ; সৃষ্টি করতে পারে সঙ্গীত; কিন্তু চির অচেনা চির অজেয় এবং স্বয়ম্ভ তার নিজেরই মন।
জালালের ওখানে থাকতেই, কী ওখান থেকে চলে আসবার কদিন পর, আমি বহুদিন পর আবার গিয়েছিলাম ফরাসগঞ্জে গোবিন্দর চা-দোকানে। কতকাল পরে সেখানে পা দিয়েই আগের মতো নাকটা ধরে উঠল রান্না করা ঝাল মুরগির ঝাঁঝালো গন্ধে, বাতাসে ধোঁয়ার গুমোট, হলুদ দেয়ালে কালির পরত–এক মুহূর্তে যেন ফিরে গেলাম আমার সেই দিনগুলোয় যখন আমি পরীক্ষায় ফেল করে তিতাস ধরেছিলাম।