সেই চা-দোকানে বসে থাকব। বসে বসে এক কাপ চা আর অনেকগুলো সিগারেট খাবো। এইসব সাংঘাতিক মিষ্টি আর কাঁচা দুধের সন্ধ ধরা চা খেতে একটুও ভালো না, তবু। দেয়ালে অনেকগুলো ক্যালেন্ডার। কোনটাতে সিনেমা স্টারদের ছবি, কোণে সাবানের নক্সা, আবার কোনটাতে ঝিল পাহাড় কী নদীতে পাল তোলা নৌকার রঙ্গিন সিনারি। দোকানে টেবিলের ঢাকনা থেকে দুপুরে খেয়ে যাওয়া মাছ তরকারির আঁশটে ভিজে ভিজে গন্ধ দেবে। পেছন থেকে অবিরাম গ্লাশ বাসন কাপ ধোয়ার টুংটাং ছলছলাৎ শব্দ আসবে। বিকেলটা নামতে থাকবে থিয়েটারের স্ক্রীনের মতো দুলতে দুলতে। ইট বোঝাই একটা দুটো ট্রাক এসে দাঁড়াবে। মাল খালাশের হুল্লোড় শোনা যাবে সারাক্ষণ। তারপর দোকানের রেডিওটা খুলবে ওরা। পাঁচটা বাজেনি। এক মিনিট কী দুমিনিট বাকি। রেডিও থেকে একটানা সিগনেচার টিউন আকাশ বাতাস জুড়ে বড় বড় আঁচড় টানছে যেন। হঠাৎ সেটা থেমে যাবে। ঢং ঢং করে বাজবে ঘণ্টা। শোনা যাবে অনুষ্ঠান আরম্ভের ঘোষণা। আর তক্ষুণি দেখতে পাবো নিশাত গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তাটা দিয়ে খুব আনমনা হাঁটছে। তার কাঁধের ওপর বড় খোঁপা থেকে কী একটা শাদার ওপর পড়ন্ত সূর্যের আলো ঝিলিক দিয়ে দিয়ে উঠছে; হেয়ার পিনের রূপোলি তীরটা, নয়ত জরির শাদা রিবন। তখন আমি উঠে দাঁড়াবো। হাঁটতে হাঁটতে যখন দেখব নিশাত ইস্কুলের কাছে চলে গেছে, তখন কাছে গিয়ে দাঁড়াবো। দেখেই নিশাত হাসবে। বলবে, কতক্ষণ? বলবো, এইতো, এইমাত্র।
নিশাত কলেজে পড়ায়। বলে, আমি একটা লেকচারার। রাস্তার মোড়ে দোকানগুলোতে কী সব আড্ডা। দুজনকে দেখলে খামোকা হি-হি করবে। তাই বেশ খানিকটা দূরে না গেলে দেখা হয় না। আমার অবশ্যি এসব বালাই নেই। এক এ্যাডভোকেটের জুনিয়র আমি; মককেলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবার সময় আসেনি। তাছাড়া, রাস্তায় কোনো মেয়ের সঙ্গে দেখবে আমার মকেল, দেখুক–পুরুষদের ব্যাপারে সুবিধে অনেক, বদনাম কম। ও নিয়ে মাথা ঘামাইনে। নিশাতের দিকটা ভাবতে হয়। বাড়িতে যেতে পারি, যেতে দেবে না ও। বলবে, ভাইজান আমাকে খুব ভালোবাসে। কিছু বলবে না তোমাকে। তবু যাবে কেন? এটাও আমি বুঝতে পারি। লজ্জার অবকাশ রাখতে চায় নিশাত, ভয় নেই তবু ভয়কে কল্পনা করতে চায় মেয়েটা। ভাবতে চায়, তার ভালোবাসায় বাধা অনেক, বিপদ বহু। লেখাপড়া শিখেছে, চাকরি করছে, সংসারের একমাত্র মাথা বড় ভাই প্রশ্রয়ে আদরে বোনকে গড়ে তুলেছেন–তবু, তবু নিশাত তার হৃদয়ের ব্যাপারে যেন কল্পনা করে নিজেকে সেই মেয়েটির মতো যাকে থাকতে হয় চার দেয়ালের মধ্যে, বেরুতে হয় লুকিয়ে, কথা বলতে হয় ফিসফিসিয়ে। বেড়ালের পায়ের শব্দে শাদা হয়ে যেতে হয় ভয়ে। আমি এটা প্রথমে বুঝিনি, বুঝেছি অনেক পরে। কিন্তু নিশাতকে বলিনি। আমার ভাবতে ভালো লাগে, নিশাতের একটা কথা জানি যা নিশাত জানে না আমি জানি। ভারী একটা বোকা ছেলেমানুষের মতো লাগে তখন নিশাতকে। যেন খেলনা–টেলনা কিনে দেয়া যাবে টানতে টানতে মেলায় নিয়ে গিয়ে।
কদিন আগে আমার সিনিয়র কাজি সাহেব একটা খুনের কেসের আসামিকে বেকসুর খালাস করিয়ে দিলেন। জুনিয়র ছিলাম আমি আর শরিফ। দুজনে কিছু মোটা টাকা পাওয়া গেল। সিনিয়র আমার কাজের খুব প্রশংসা করলেন বাসায় একা ডেকে। তাঁর ছোট শালী রুমি থাকত এ বাড়িতে। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে এবার। রুমি চিড়ে ভাজা আর চা এনে রাখলো। আড়চোখে তাকাল একবার আমার দিকে। চোখের কোণে ঝিলিক দিয়ে উঠলো হাসি! ছুট দিল ভেতরে।
মেয়েটা কালো, নাকটা কেমন ছড়ানো, পাতলা ঠোঁট, শরীরটা ছিপছিপে, ভালো করে কাপড় পড়তে জানে না, রংও চেনেনা। সবুজ শাড়ি পরেছে। ভারী বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। কিন্তু খুব চঞ্চল। ঐ চঞ্চলতাটুকুর জন্যে একেক সময় আমার ভালো লাগে। কোন কোন দিন একটু দেখতেও ইচ্ছে করে এক মুহূর্তের জন্যে। তারপর আর মনে থাকে না। আবার একেকদিন আমার সিনিয়রের পুরনো ফোর্ডে চেপে কোর্টে যাবার পথে রুমি এসে সামনে বসে। সে কলেজে যাবে। সারাক্ষণ তার ভিজে ভিজে বেণি দুটো বড়ড ভারী আর নির্জীব দেখাবে, তেলে মলিন লাল ফিতেটা থেকে কী কোথা থেকে একটা জ্বালা ধরানো গন্ধ বেরুবে। মেয়েটা আমার সিনিয়রের লায়াবিলিটি। শ্বশুর মারা যাবার সময় জামাইর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বলে শরিফ বলছিল। শরিফকে বলেছিলাম, তুমি বিয়ে করো। উন্নতি চড় চড় করে হবে। ভদ্রলোকও বাঁচবেন। তোমার নতুন করে এস্টাবলিশমেন্টের খরচ আর লাগবে। শুনে শরিফ নাক সিটকে ওয়াক করে নাটকীয় ভঙ্গিতে থুতু ফেলে বলেছে, তোবা তোবা। তুমি থাকতে আমি? ময়ূর থাকতে দাঁড়কাক?
ব্যঙ্গচ্ছলে শরিফ নিজেকে দাঁড়কাক আর আমাকে ময়ূর বলেছে। উপমাটা বেজেছে কিন্তু আমার অন্যখানে গিয়ে। রুমি আর নিশাত। নিশাত আমার ময়ূর।
এটা একটা মুশকিল হয়েছে। আমি মাঝে মাঝে টের পাই, কোনো কারণ নয় এমনিতেই যেন বুঝতে পারি, আমাকে নিয়ে কথা হয়। মনে হয়, কাজি সাহেব আমার চারদিক থেকে জাল এমনভাবে গুটিয়ে আনছেন যেন একদিন সঙ্কুচিত হতে হতে হঠাৎ দেখতে পাবো আমি রুমির বাহুবন্ধনে বাঁধা পড়ে গেছি। একেকদিন খুব অস্বস্তি করে যখন ভাবনাটা হয়ে ওঠে। প্রবল। চেম্বারে বসে ঘামতে থাকি। বেরুতে পারলে যেন বাঁচি।