আশ্চর্য, মানুষের মনের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মুখের রেখা বদলায় না, তা যদি বদলাতো তাহলে এই পৃথিবীতে বাস করা সহজ হতো অনেক।
সেদিন রেস্তোরাঁয় আমি বসেছিলাম স’পাঁচটায়। সাতটায় দেখা করবার সময় ছিল নিশাতের সঙ্গে। কিন্তু তার আগে ঘটলো অঘটন, আমার চশমার কাঁচ আচ্ছন্ন হয়ে গেল কালোকফির ধোঁয়ায় এবং আমি বিকৃত হতে লাগলাম হত্যাকারী হিসেবে। আমার মনে হলো, আগেই বলেছি, এখন আমার পক্ষে পৃথিবীর যে–কোন পাপ করা সম্ভব এবং তা হচ্ছে লঘুকীর্তি। মনে হলো, এই বেঁচে থাকাটা অর্থহীন এবং আরো মনে হলো, ততোধিক অর্থহীন মৃত্যু।
সেই মুহূর্ত থেকেই আমার অধঃপাতের শুরু। কিংবা একে নবজন্ম বলব? জীবনের নতুন মুখ? এই কয়েক বৎসর আমি বয়সে যা না বেড়েছি তার চেয়ে মনটা বুড়ো হয়েছে। পুরনো আর প্রচলিত কথাগুলো এখন আমিও সোচ্চারে বলতে শুরু করেছি। যেমন, অধঃপাতের কথা লিখতে লিখতে আমি ভাবছি, আসলে আমরা কি জানতে পারি কোনটা আমাদের জন্যে ভালো আর কোনটা খারাপ? যা হয় মঙ্গলের জন্যেই হয়। এবং বুড়োদের মতো এখন আমিও বলতে দ্বিধা করি না. আমাদের সমস্ত ভবিষ্যৎ লেখা হয়ে আছে কোথাও না কোথাও; অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিভিন্ন মানুষেরই কীর্তি।
ভাগ্যবাদীতার শুরুও সেদিন সেই বিকেলেই হয়েছিল, আমি অনুমান করছি। কারণ, নিজের বিধ্বস্ত স্বপ্ন থেকে চোখ তুলে যখন সময় দেখলাম, তখন সাড়ে সাতটা বাজে। নিশাতের সঙ্গে দেখা করবার নির্ধারিত সময় আধঘণ্টা হলো পেরিয়ে গেছে। এতক্ষণ বসে বসে কফির পেয়ালায় আমি বারবার সেই ছবিটাই দেখছিলাম আমার দৌড়ে আসা, দৌড়ে এসে ধাক্কা দিলাম বাবাকে, তিনি গড়িয়ে পড়লেন, একটা ধ্বস খসে পড়বার আগেই চিৎকার করে পিছিয়ে এলাম আমি।
অভিভূতের মতো উঠে এলাম রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এসে দেখি সিনেমা হলের মাথায় নতুন ছবির ব্যানার লাগাচ্ছে। নৃত্যভঙ্গিমায় দাঁড়ানো মেয়েটির কাটা ছবিতে দড়ি পরিয়ে আস্তে আস্তে কুলিরা টেনে তুলছে পোর্টিকোর মাথায়। একটা অতিকায় স্বপ্নের মতো সে উঠে যাচ্ছে। আমি হা করে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম।
আমার যাওয়া হলো না। নিশাত এতক্ষণে আমার জন্যে ইস্কুলের বোর্ডিং গেটে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে ফিরে গেছে। কাঁঠালতলা দিয়ে পুকুরের পাড় ভেঙ্গে বাসায়। বাসায় গিয়ে খোকনকে কোলে নিয়ে হয়ত ভাবছে কেন আমি এলাম না? আমিতো কোনদিন কথা দিয়ে এরকম করিনি। হয়ত কাঁঠালগাছের নিচেও দাঁড়িয়েছে কিছুক্ষণ যদি আমি শেষ মুহূর্তে আসি, যদি শোনা যায় কোনো স্কুটারের শব্দ।
নিশাত কি জানবে কী আমার হয়ে গেছে। নিশাতকে আমি কোনদিন বলতে পারব না। ঠিক তখন ইন্টারভ্যাল হলো। আচমকা ভরে উঠল সিনেমা হলের সামনের জায়গাটুকু। আর দাঁড়িয়ে থাকা গেল না। লোকের ধাক্কায় আমি ক্রমাগত নাজেহাল হচ্ছি।
তখন হাঁটতে শুরু করলাম। সিঙ্গারের সামনে দিয়ে চলতে লাগলাম স্টেডিয়ামের দিকে। সে চলায় না আছে কোনো উদ্দেশ্য, না কোনো চেতনা আমবে মনে হচ্ছে, আমাকে এরকম। হাঁটতে হবে এবং থামলে চলবে না। যেন আজ সারারাত্রির মধ্যে আমি হাঁটতে পারলো এবং পৌঁছে যেতে পারবো পৃথিবীর অপর প্রান্তে।
আজ আমার মনে হয়, সত্য থেকে পলায়নের স্পৃহা সে মুহূর্তে প্রবল হয়ে উঠেছিল আমার ভেতরে।
স্টেডিয়ামের মোড়ে দাঁড়িয়ে ওষুধ বেচা হকারদের খেলা দেখলাম খানিক; আবার হাঁটতে শুরু করলাম। সেকেণ্ড গেটের পাশে একসিডেন্ট হয়েছে, উল্টে পড়ে আছে নতুন ঝকমকে একটা গাড়ি, পাশে দাঁড়ানো একটা ট্রাক, ড্রাইভার পালিয়েছে। লোকেরা উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলছে, দৌড়ুচ্ছে, ভিড় করছে, আহতকে আরেকটা গাড়ি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি সেখান। থেকে এগিয়ে বড় চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবলাম কোনদিকে যাবো। একটা সিগারেট ধরালাম। তেতো লাগল। কাশি উঠল। হাঁটতে লাগলাম পার্কের দিকে, পার্ক পেরিয়ে রেসকোর্স বা হাতে ফেলে অন্ধকার গা ছমছমে রাস্তা দিয়ে শাহবাগের দিকে। শাহবাগের সামনে সার সার। ট্যাকসি দাঁড়িয়ে আছে। যেন বিরাট বিরাট হলুদ কালো ফুলের মালা গেঁথে রাতের রাস্তায় ফেলে রেখে গেছে কেউ।
কাল নিশাতকে টেলিফোন করব। কালকের কথা কাল ভাবা যাবে। আবার আমি হাঁটছি। আর্টস্কুলের বিরাট খোলা সিঁড়িতে দুধের মতো আলো বয়ে যাচ্ছে। গাছের গায়ে কারা যেন। কোন্ আন্দোলনের পোস্টার সেঁটে গেছে। দেখা যাচ্ছে পাবলিক লাইব্রেরীর দেয়ালে আঁকা ছবির একটা অংশ। আমি থমকে দাঁড়ালাম।
একটা লোক আমার কাছে সিগারেট ধরাবার জন্যে আগুন চাইল। ধরিয়ে নিয়ে গেল সে। আমি এগুলাম। নীলক্ষেত ফায়ার স্টেশনে লাল গাড়িগুলো জ্বলজ্বল করছে। বারান্দায় তাস পিটছে কারা? সামনে সুন্দর করে ছাঁটা ফুলের কেয়ারি, ঘন ঘাসের ঝোপ।
নদী ভাঙছিল। আমরা দেখতে গিয়েছিলাম। আমি দৌড়ে এসে ধাক্কা দিয়েছিলাম বাবাকে। একটা বড় ধ্বস ভেঙে পড়ল তারপর। তিনি আর উঠে আসতে পারেননি। এই ছাব্বিশ বছর কোথায় ছিল এই ছবিটা?
রাস্তার লোকগুলোকে একেবারে অন্যগ্রহের মনে হচ্ছে। তারা আসছে যাচ্ছে, গাড়ি বাস ছুটে চলেছে, রিকশাওলা বেল বাজাচ্ছে–কোনো কিছুর সঙ্গেই যেন আমার আর কোনো বন্ধন নেই।
আজিমপুরে আমার এক ক্লাশের একদা বন্ধু থাকতো। কখনো সখনো যেতাম তার ফ্ল্যাটে। তার দরোজায় গিয়ে ধাক্কা দিলাম। সে দরোজা খুলে অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিগ্যেস করল, কী হয়েছে তোমার? অসুখ?