ফিরে তাকাবো কী, আমার মনে তখন শূন্য মাঠে তপ্ত বাতাসের ঘূর্ণি হচ্ছে। আমার তখন একটাই কথা, আমি যখন আমার বাবাকেই এই দুহাতে ধাক্কা দিয়ে হত্যা করতে পেরেছি, তখন পৃথিবীতে আমার কিসের ভয়, কিসের তোয়াক্কা। আমি যেন যা খুশি তা করতে পারি। যে ছেলে পরীক্ষায় ফেল করেছে তার অঙ্কে দশ পেলেই কী আর আশি পেলেই বা কী? আমার যেন সমস্ত নীতি, শৃঙ্খলাবোধ, সব তছনছ হয়ে গেছে; উচ্চাশা হাস্যকর, সংসার অসম্ভবের আহ্বান, কর্ম এবং অর্থ অর্থহীন। যে শাস্তি আইন আমাকে দিতে পারেনি, তার চেয়ে বড় শাস্তি সৃষ্টির সাধনা তখন আমি করছিলাম সমস্ত স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়ে, সাধ উপেক্ষা করে, আত্মনিপীড়ন আর বঞ্চনার ভেতর দিয়ে।
সেন্ট, শাড়ি, চপ্পল কিনেছিলাম কার কথা মনে করে এখন আর মনে নেই। নিশাতের কথা ভেবে থাকব? কিন্তু নিশাত তখন আমার চেনাজগৎ থেকে এত দূরে যে তাকে মনে হতো মৃত একটি মানুষ, যার নাম আমার মনে আছে, মুখ; কিন্তু যার কাছে আর যাওয়া যায় না। রুমি? সম্ভবত তাও নয়। কারণ, রুমি হলে আমি বেছে বেছে গাঢ় রংয়ের শাড়িগুলো কিনতাম না। রুমি ছিল কালো; আমার বেশ মনে আছে, রুমি একেকদিন সবুজ বা ঐ রকম গাঢ় রংয়ের শাড়ি পরতো বলে আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠতো। আমি যা কিনেছিলাম তা একজন ফর্সা রক্তিম মেয়েকেই মানাতো বেশ। ফিরোজার জন্যেও কিনিনি। কারণ, সেদিন রেস্তোরাঁয় কালোকফির ধোঁয়ায় চশমার কাঁচ ঢেকে আসবার মুহূর্তেই আমার সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে মোরশেদ সাহেবের পরিবারের সঙ্গে।
আজ আমার মনে হয়, নিশাতকে ভুলেও আমি ভুলতে পারিনি সেদিন–যেমন আজো পারিনি, এই লেখার মুহূর্ত পর্যন্ত পারছি না। নিশাতের কথা ভেবেই হয়ত কিনেছিলাম ওগুলো। যে দেয়াল আমি নিজেই তুলেছি, তা ভেঙ্গে আবার নিশাতের কাছে ফিরে যেতে পারবো না; কারণ, আমার আত্মাভিমান বড় প্রবল তখন। যা কিছু ছিল আমি যে আমিই, এবং আমার সব সঠিক– এই অহঙ্কারটা ছিল ষোলআনা। কিন্তু মনের একেবারে শেষ কোণায় বোধহয় আকাক্ষাটা মরেও মরেনি; এই আশেপাশেটা যায়নি, যে ইচ্ছে করলেই নিশাতকে আমি বউ করতে পারতাম। তাই ওই সেন্ট, শাড়ি, চপ্পল কেনার ভেতর দিয়ে হয়ত অসম্ভব আশা করেছি, নিশাতকে আমি নিজেই সৃষ্টি করে নিতে পারবো। জিনিসগুলোর মধ্যে তার রক্তিম উষ্ণ শরীরটা যেন স্পন্দনমান হয়ে উঠবে। এটাকে আমার এখন মনে হয় মস্তিষ্ক বিকৃতির এক ধরনের লক্ষণ। কিন্তু তখন সেটা বুঝতে পারিনি কারণ, তখন আমি যা করছিলাম তা–ই মনে হচ্ছিল এবং যে কোনো যুক্তি ও সত্যের বিরোধিতা করবার জেদ ছিল প্রচুর।
বাড়ি বয়ে নিয়ে এসে, মনে আছে, প্রথমেই হাঁক পেড়ে ডাকলাম জালালের স্ত্রীকে। তিনি ছেলেটাকে পড়াচ্ছিলেন মেঝেয় শুয়ে শুয়ে। আমার আওয়াজ শুনে ধরমর করে উঠে এলেন। গায়ে গতরে শাড়ি টানতে টানতে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি বলি, কে না কে? এগুলো কী?
দেখুন না কী? বলতে বলতে তার হাতে তুলে দিলাম সেন্ট, শাড়ি, চপ্পলের ব্রাউন কাগজ মোড়া প্যাকেটগুলো। জালাল আমার দিকে চকচকে চোখে তাকাল, যেন মহা দুর্বোধ্য কিছু তার চোখের সামনে ম্যাজিকের মতো ঘটে যাচ্ছে।
আমার এখন হাসি পায়, আমি ওকালতি করতাম, মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আমাকে কারবার করতে হতো, অথচ সেদিন যা করলাম তা নেহাৎ মূখের কী নির্বোধের মতো একটা কাণ্ড; পূর্বাপর ভাবলাম না একটুও, জালালের স্ত্রীকে সেই শাড়ি চপ্পল দিয়ে বসলাম। তার সঙ্গে আমার ঠাট্টা চলত, জালাল আমার ভালো বন্ধু। তারো চেয়ে সত্য, মানুষের মন এক জটিল যন্ত্র যার কোন্ কাটার আবর্তনে কোন্ কাঁটা ঘুরবে তা অঙ্ক-ফলের মতো বলা যায় না।
জিনিসগুলো খুলতে খুলতে জালালের স্ত্রীর মুখে গভীরতর হতে লাগল আনন্দ–উল্লাসের রেখাগুলো, ছোট্ট একটা মেয়ের মতো খুশি দেখাতে থাকল সে। আমি সেদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম।
নিশাতের সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে না, একথাটা ওদের জানানো হয়েছিল কিনা মনে নেই। খুব সম্ভব বলেছিলাম। এবং এটা আরো সম্ভব, মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে নিশাতের সঙ্গে আমার সম্পর্কের এত বিরাট পরিবর্তন কী করে ঘটল তা জানবার জন্যে ওরা স্বামী স্ত্রীতে ভীষণ পীড়াপীড়ি করেছিল আমাকে। সম্ভবত এইজন্যে বলছি, আমার উপহার তাহলে জালালের মুখ কালো করে দিত না। জালাল ভেবেছিল, আসলে আমি একা উড়নচণ্ডি লক্কা পায়রা– এইমাত্র একটি মেয়েকে কথা দিয়ে আর বিয়ে করলাম না এবং পরদিন বিনি মাশুলে গাড়ি চড়ার আনন্দ খুঁজতে বেরুলাম কৌশলে বন্ধু–স্ত্রীর প্রতি নিজের অনুরাগ জানিয়ে। আমি জালালকে দোষ দিই না। নিশাতের মতো সাফ মাথা, অনুভূতি–সম্পন্ন মেয়েই যদি ভুল বুঝতে পারে তো জালাল কোন ছার। জালাল আমার বন্ধু কেবল, আর নিশাতের সঙ্গে ছিল আমার হৃদয়ের সম্পর্ক।
এ সবই ভুল। একটা মানুষ কিছুতেই বুঝতে পারে না আরকটা মানুষকে। যত নিকট হোক দুটি মন, এমনকি তারা বিনিময় করুক তাদের রক্ত, তবু তারা বুঝতে পারবে না একজন আরেকজনকে সম্পূর্ণভাবে। যে সেতু আমরা কল্পনা করে থাকি তা সেতুর বিভ্রম মাত্র। নইলে মুখে না বললে, ভাষায় না ভাবনাকে ব্যক্ত করলে কেন অচল হয়ে যায় জগৎ? নিশাতকে যেহেতু আমি কিছুই বলিনি আমার চেতনার বৈপ্লবিক পবির্তনগুলো সম্পর্কে, সে হয়ত মনে করে বসে আছে, আমি সেই আমিই আছি এবং আসলে আমি এক হৃদয়হীন পশু।