কফির ধোঁয়ায় চশমার কাঁচ যখন কুয়াশা হয়ে গেল, তখন কোন ইন্দ্রজালে অবচেতনের রুদ্ধ দুয়ার খুলে গেল। ছড়িয়ে ছিটকে পড়ল আমার গ্লানি, আমার পাপ, আমার ক্ষমাহীন অস্তিত্ব। আমার কাছে লুপ্ত হলো আশা বাস্তব এবং বর্তমান; দুলে উঠল অতীতের ভারী পর্দা যা ঢেকে রেখেছিল আমার স্মৃতিকে।
পেয়ালার দিকে তাকিয়ে একে একে মনে পড়তে লাগল পেছনের দিনগুলো। আমাকে কোন আয়াসই স্বীকার করতে হচ্ছে না, তারা আপনা থেকেই আসছে এবং দেখিয়ে যাচ্ছে নিজেদের গঠনগুলো। ছাব্বিশ বছর যে স্মৃতির কোনো চিহ্নমাত্র ছিল না, ঈশ্বর তা বিস্মৃতির ধূলি থেকে আবার নবদেহে হাজির করতে লাগলেন। দেখলাম, আমি শিশু হয়ে গেছি। দেখলাম, বাবার হাত ধরে আমি দাঁড়িয়ে আছি বাড়ির সামনে ঘাসের ওপর, বেলা পড়ে যাচ্ছে। আবার দেখলাম, ও পাড়ার এক গরিব বউ এসে মার কাছে চাল চাইছে–আমাকে দেখে হাসছে আর বলছে, গ্যাদা কত বড় হইছে গো। শুনলাম, এই আমার দাই মা। দাই মা আবার কেমন মা? স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি সারাদিন একা একা হাঁটছি আর এ কথাটা ভাবছি।
কোথায় ছিল স্মৃতিগুলো এই ছাব্বিশটি বছর? মার একটা কথার শেষ যেন উড়িয়ে দিয়েছে শোয়ার দরোজা, পতন হয়েছে বিস্মৃতির নগরের, ঐ দেখা অচ্ছে। দেখলাম, নদীতে প্রবল স্রোত নেমেছে, ঘোলা পানি খল খল করে তালি বাজাতে বাজাতে ঘুরতে ঘুরতে বয়ে চলেছে; তার মুখে গাছপালা বাড়িঘর কিছু আটকাচ্ছে না, পাড় থেকে বড় বড় চাঙ্গড় ধ্বসে পড়ছে। দিনরাত। ভোর রাতে আমাকে ঘুম থেকে তুলে বাবা বললেন, গ্যাদা চলো, নদী দেইখা আসি। ভাঙতেছে।
আমি ভোরের অস্পষ্ট আলোর ভেতরে চলছি চোখ ডলতে ডলতে। ক্রমে রাঙা হয়ে উঠছে। সূর্য, আস্তে আস্তে বাড়িঘর গাছপালার ছবি স্পষ্ট হয়ে আসছে, দূর থেকে বেতালা ঢাকের মতো আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি আর নাকে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে ভোরের ফুরফুরে হাওয়া।
বাবা বললেন, শুনছাও? নদী ভাঙ্গে তার আওয়াজ। য্যান ঢাক বাজে না?
তখন আমার খুব ফুর্তি হলো। বাবা হাত ছেড়ে দিয়ে লাফাতে লাফাতে তার আগে আগেই চললাম। তিনি পেছনে থেকে মুখে যদিও বললেন, দেইখ্যা, পইড়া যাইবা, কিন্তু বাধা দিলেন না আমাকে।
একেবারে সেদিনকার কথার মতো আমার মনে পড়ছে এই লাফিয়ে চলার দৃশ্যটা। মনে করতে করতে চোখে পানি এসে গেছে আমার, খেয়াল করিনি। কফিতে একটা চুমুক দিয়ে নড়ে-চড়ে বসলাম তখন। সিগারেট ধরালাম। ধরিয়ে দেখি, স্মৃতির সূত্রটা ছিঁড়ে গেছে। ধারাবাহিকভাবে কিছুতেই আর মনে পড়ছে না কিছু। যেন ঐ লাফিয়ে চলাটা অনন্তকাল পর্যন্ত চলেছিল।
তারপর যে ছবিটা মনে পড়ল—-দেখতে পাচ্ছি, বাবা নদীর উঁচু পাড়ের একেবারে কিনারায় দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে কী দেখছেন। আমি তার পেছনটা দেখতে পাচ্ছি অনেক দূর থেকে। খুব মজা লাগছে আমার বাবাকে অমন ঝুঁকে পড়ে থাকতে দেখে। দৌড়ে এসে হাসতে হাসতে তাঁর পিঠে দিলাম ধাক্কা; এখনি তিনি যেন সচকিত হয়ে উঠবেন এবং দেখে হেসে ফেলে তাড়া করবেন ধরবার জন্যে, যেমন আমার খেলার বন্ধুরা করে থাকে। কিন্তু বাবা সে সব কিছুই করলেন না। বিরাট একটা গাছের গুঁড়ির মতো গড়িয়ে পড়লেন নদীর ভেতরে। ছলাৎ করে একটা শব্দ উঠল। আমার চোখের সামনে হাত খানেক মাটিতে সরু কালো সূতোর মতো চিড় ধরলো। চিৎকার করে পেছনে ছুটে আসতেই দেখলাম একটা বড় চাঁদের আকারে খানিকটা পাড় ধ্বসে পড়ল নদীতে যেখানে একমুহূর্ত আগে ছিলাম আমি এবং আমার একমুহূর্ত আগে বাবা।
আর মনে নেই। তারপর যে স্মৃতিটা একেবারে পিঠেপিঠে মনে পড়ে তা হচ্ছে আমার চাচি ডিমের মতো গোল দলা পাকিয়ে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন আমাকে আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে। এই একটা ছবি বাবার গড়িয়ে পড়া, আমার লাফিয়ে পেছনে হটে আসা, বারবার ফিরে ফিরে মনে পড়তে লাগল রেস্তোরাঁয় বসে। যেন এমনি করে দেখে দেখে আমি আরো কিছু নতুন তথ্য আবিষ্কার করতে পারবো। আমি তো হত্যাকারী, বাবাকে হত্যা করেছি, নতুন কোনো তথ্য যেন সে সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে আরো; আমাকে নিঃসন্দেহে প্রতিপন্ন করবে। জগতের ঘৃণ্যতম অপরাধী হিসেবে।
পেয়ালার কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আরো এক পট আনতে বললাম বেয়ারাকে। একটু আগে যাকে আমার মনে হয়েছিল আদালতের ব্যারিস্টার, অভিযুক্ত করছে আমাকে, চরম শাস্তি প্রার্থনা করছে আমার জন্যে, সে আরেক পট কফি এনে রাখলো।
আজ আমি আর ওকালতি করি না, কাজি সাহেবের জুনিয়রি ছেড়ে দিয়েছি যেন কত যুগ আগে, তাই আজো আমার স্পষ্ট করে মনে পড়ে ওয়েটারের কালো কোটকে ব্যারিস্টারের কালো কোট বলে ভুল করার করুণ সম্ভব মুহূর্তটি।
আমার তখন ঝোঁক চেপে গিয়েছিল নিজেকে বিভিন্নভাবে কষ্ট দেয়ার। যে কয়েক হাজার টাকা ব্যাঙ্কে ছিল, তা আমার শেষ নির্ভর, আমার অনেক স্বপ্নের ভিত্তি। প্রথমেই সে টাকাগুলো উড়িয়ে ছত্রখান করে দেবার তীব্র বাসনা হলো। একদিন পাঁচশ টাকা তুললাম। কিন্তু কী করা যায় পাঁচশ টাকা দিয়ে এই ঢাকা শহরে? একটা দোকানে উঠে সেন্ট কিনলাম এক গাদা, শাড়ি কিনলাম, মেয়েদের চপ্পল পছন্দ হলো দুজোড়া–তাও নিলাম। আর নিজের জন্যে, যা কোনদিন পারব কল্পনা করিনি, কিনলাম দামি টোব্যাকো, পাইপ, ড্রেসিং গাউন আর একটা সোনার ক্যাপ কলম। এক সন্ধ্যায় ফতুর পাঁচশ টাকা। আজ সে সব কথা মনে পড়ে হাসি পায়। সিনেমা দেখার অভ্যেসটা ছিল আমার মোলআনা; মনে হয়, বাংলা কোনো ছবিতে কাউকে দেখে থাকব গাউন পরে পাইপ খেতে, কথা বলতে অত্যন্ত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে –তাই নিজের জন্যে ওগুলো কিনেছিলাম। আসলে নিজেকে শক্ত সবল করে দাঁড় করানোর হাস্যকর প্রয়াস হিসেবেই এই কেনার অভিযান, যা তখন বুঝতে পারিনি। এখনো হয়ত সুটকেশের তলায় পড়ে আছে গাউনটা, প্রথম কয়েকদিন ব্যবহারের পর সেই যে ফেলে রেখেছি আর ফিরে তাকানোও হয়নি।