। আমি যে বুঝতে পেরেছি এটা টের পেয়ে মার মুখ রাঙা হয়ে উঠল। এবং আমার তখন সেই মুহূর্তে সেই এক দুপুরের রৌদ্র ঝরা বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে তুলতে চিরদিনের চেনা মনে হলো মা-কে।
সেই রাঙা হাসিটা মনে আছে আমার যে কোনো এইমাত্র দেখা ছবির মতো। আরো বিশেষ করে মনে আছে এই কারণে যে, অমৃতের মতো মধুর মনে হয়েছিল যে মুখ, সেই মুখ কল্পনার চোখে যদিও, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আজ কিন্তু অনুভূতির লেশমাত্র আর নেই। কী করে এই বিচ্যুতি ঘটলো, স্মৃতির ছবি থেকে কখন অপসারিত হলো অর্থের ইন্দ্রজাল, তা বিশ্লেষণ করলে দুটো পাঁচটা রাত কেটে যাবে, কোনো তথ্য দিতে পারব না।
আমার সেদিন আর যাওয়া হলো না। তার পরদিনও না। পরদিন দুপুরবেলায় মা আমাকে তার প্রথম বিয়ের লাল চেলিটা ভাঁজ করে বুকের কাছে লুকিয়ে এনে দিলেন। আমি খুব অবাক হলাম। সকালে মাকে বলেছিলাম, নিশাতের কথা। বলছিলাম, আমার বিয়েতে তার আসা চাই। তিনি মুখে কিছু বললেন না, নামিয়ে নিলেন মুখ, তার কোলের পরে ঘুমিয়ে পড়ল সব ছোট মেয়েটা আমি বুঝতে পারলাম, আসলে আমার মা–কে ডাকাই উচিত হয়নি। আমার বয়স হয়েছে, এবং আমার বোঝা উচিত ছিল, মার পক্ষে কিছুতেই এখন আর সম্ভব নয় এই বাড়ির বাইরে এসে তার প্রথম পক্ষের ছেলে, আমি, আমার সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করা। অত্যন্ত লজ্জিত হলাম। মার জন্যে আমার প্রবল কষ্ট হলো। সেটাকে কবর দেবার জন্যে জোর করে হেসে বললাম, বিয়ের পরে নিয়ে আসব নিশাতকে।
আমার দিকে বোবা চোখে তাকালেন তিনি। তখন সে চাহনিটার কোনো অর্থ স্পষ্ট হয়নি আমার কাছে, কিংবা অবান্তর একটি অভিব্যক্তি বলে মনে হয়েছে ওটা, যা আমরা অহরহ প্রশ্রয় দিয়ে থাকি যে কোনো দুজন বা তারো বেশি একসঙ্গে বসলে। আমার ফিরতি ট্রেনটা যখন আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল ঢাকার দিকে, তখন বিচ্ছিন্ন অনেকগুলো ছবির ভেতরে মার এই বোবা চাহনিটা মনে পড়েছিল। কিন্তু তখনো বুঝতে পারিনি কী তিনি বলতে চেয়েছিলেন সে দৃষ্টি তুলে। আজো তার সন্ধান পাইনি। অথচ, আমার স্মৃতি যখন এত উজ্জ্বল করে ধরে রেখেছে সেই চাহনিটা, তখন নিশ্চয়ই তার কোনো মানে আছে, আমার মনে এত গভীর দাগ কেটে গেল যে মুহূর্ত, তার অর্থ আমি না জানলেও কোথাও না কোথাও লেখা আছে।
লাল চেলিটা হাতে নেবার পরও ভালো করে বুঝতে পারিনি আমি একটা বিয়ের শাড়ি হাতে করে আছি, এবং এই শাড়ি পরে আমার বাবাকে প্রথম দেখেছিলেন মা আজ থেকে তিরিশ বছর আগের এক রাতে। শিরশির করে উঠলো আমার গা। নিঃশ্বাস ভারী করে তুললো দীর্ঘদিন ট্রাঙ্কে বন্দি হয়ে থাকার মোহনীয় ঘ্রাণ। বোকার মতো জিগ্যেস করলাম, কার? কার আবার? আমার বিয়া হইছিল এই শাড়ি পইরা।
বলে না দিলেও বুঝতে পারলাম বিয়ে মানে আমার বাবার সঙ্গে বিয়ে। বুঝতে পারলাম দীর্ঘ বৎসরগুলো মা এই শাড়ির সঙ্গে তার প্রথম পুরুষ, ভালোবাসা, ভয়, মৃত্যু ও অশ্রুকে একত্রিত করে সমস্ত আলো ও বাস্তব থেকে দূরে তোরঙ্গের তলায় নিরন্ধ্র গহ্বরে চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। জানতে পারেনি বিশ্ব, হয়ত তিনি নিজেও ভুলে গেছেন একদিন আস্তে আস্তে; আমি সেই মৃতকে জীবন্ত করে তুললাম।
বললাম, কী করব?
বউরে দিও।
আমার এখনো মনে আছে সেই শাড়িটা নিয়ে আমি অনেকক্ষণ বসেছিলাম অবাক হয়ে। বৃষ্টির মতো নরোম গুঞ্জনে, কিসের কে জানে, আচ্ছন্ন হয়ে আসছিল আমার মন। মার দিকে দেখছিলাম। এবং আমার কিছুতেই যেন খুশির কুলান হচ্ছিল না হৃদয়ে। রিয়াজ এসে আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল, টানাটানি করতে লাগল শাড়িটা নিয়ে। মা তাকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললেন, সর, সর, ডাকাইত।
এক সময় ফিরোজা বলল, বউ নিয়া আসবেন কইলাম।
আচ্ছা, আসব।
এখন আমার ভালো করে মনেও নেই সেদিন কোন ঘটনা কোনটার পরে ঘটেছিল। মার শাড়ি দেয়া, ফিরোজার অনুবোধ, রিয়াজের এসে দাঁড়ানো–এসব কোন অনুক্রমে ঘটেছিল? কেবল এটুকু মনে আছে আমার মনটা খুব ভালো ছিল, আমি বেশ সহজ হয়ে উঠেছিলাম, পরদিন আসবার সময় খুব খারাপ লেগেছিল আমার, ফিরোজা আর মা বাড়ির শেষ সীমানা পর্যন্ত এসে পুকুরের ওপারে সুপুরি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে যতদূর দেখা যায় তাকিয়েছিলেন। আমি ধরা গলায় বলেছিলাম, আবার আসব, বউ নিয়ে।
আগাগোড়া ঘটনাগুলোর মধ্যে কোথায় যেন একটা ফাঁকি ছিল যেটা আমি তখন বুঝতে পরিনি। আমি সহজইে ভুলে যেতে পেরেছিলাম প্রথম রাতে দুঃস্বপ্নের মতো মার আবির্ভাব আর বিয়ের মতো মৃত্যুময় কিন্তু সত্য, আমার বাবার সেই মৃত্যুর ইতিহাস এবং সহজেই পেরেছিলাম এই সংসাব, যে সংসার আমার নয়, যে সংসারে আমি চিরদিনের অবাঞ্ছিত, সেই সংসারকে আপন করে দেখতে; এমন কি ফিরোজাকে আমার ভাল লাগতে চেয়েছিল, রিয়াজকে আমি শহরে নিয়ে যাবার কথাও চিন্তা করেছি।
ফাঁকি ছিল নিশ্চয়ই, আমি আমার অজান্তে অভিনয় করেছিলাম। এছাড়া আর কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে অমন ব্যবহারে। বাবার মুত্যু ইতিহাস শোনবার পর নিজের দুঃসহ গ্লানি ঢাকবার হয়ত ব্যর্থ চেষ্টা ছিল ওগুলো। নইলে ওখানে দুদিন, তারপর সারাদিন সারারাত ট্রেনে ঢাকায় ফেরা, ঢাকায় ফিরে এই বিকেল অবধি কম করে হলেও মোট নব্বই ঘণ্টাব মধ্যে একবারও কেন মনে পড়ল না রাতে মায়ের মুখে শোনা কথাগুলো? আমার হাতে বাবার মৃত্যু হয়েছে, এই অপ্রত্যাশিত খবরটা নিয়ে কোনো আলোড়নের স্মৃতিই আমার মনে নেই।