এই পৃথিবীটাকে আমার মনে হয় এক অর্থহীন অদ্ভুত চক্রান্ত, যার ভেতর থেকে আমরা আমাদের নিজস্ব অর্থ বার করে নিই–এবং যার একাংশও বোধগম্য নয় আরেকজনের কাছে। কাল রাতে বাজ পড়ল, আজ আমার ছেলেটা মারা গেল–অতএব বাজ পড়াটা ছিল মৃত্যুর অগ্রদূত, এমনি করেই তো দুই বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্যে ঐক্য খুঁজেছি, অর্থের সঞ্চার করেছি আমরা। সঞ্চার বলাও ভুল, বলতে পারি –জন্ম, জন্ম দিয়েছি অর্থের। মানুষ বোধহয় অর্থহীন, সম্পর্কহীন কোনকিছুকেই ধারণা করতে পারে না। সম্ভবত তার রক্তের মধ্যে রয়েছে এক অসীম–শূন্যতার আতঙ্ক, যার হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে মানুষ প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টি করছে স্বপ্ন আর বিভ্রম।
আমি কি ব্যতিক্রম?
কী জানি। কিন্তু আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আমার সমুখে কালোকফি, তার ধোঁয়ায় চশমার কাঁচ হঠাৎ কুয়াশা হয়ে যাওয়া, এর সঙ্গে আমার বাবার মৃত্যুর ইতিহাস মনে পড়ে যাবার কোনো সম্পর্ক নেই। তবু মনে পড়েছে। এবং এত কঠিনভাবে মনে পড়েছে যে আমার পুরনো পৃথিবী ধ্বসে ধ্বসে পড়ছে তার নির্মম আঘাতে, ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসছে। আমি তাকিয়ে আছি পেয়ালায় রাখা কালোকফির দিকে। আস্তে আস্তে বাতাসে কেটে যাচ্ছে কাঁচ থেকে বাষ্পের কণাগুলো। স্বচ্ছ হয়ে আসছে। আবার আমি দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি মৃদু রেখায় তখনো ধোঁয়া উঠছে পেয়ালা থেকে।
এ সবই কয়েকটি সেকেণ্ডের মধ্যে ঘটে গেছে। কিন্তু আমি সেই পুরনো আমি আর নেই। আজ যখন পেছনের দিকে তাকিয়ে এই ঘটনাটা মনে করবার চেষ্টা করছি, আবার যখন মুহূর্তগুলোকে তাদের সম্পূর্ণ বিবরণের জন্যে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি, তখন এক হতাশায় ভরে আসছে আমার মন, ক্লান্ত হচ্ছে আমার কলম। কারণ, কিছুই সঠিক অনুক্রমে মনে পড়ছে না, অনেক জরুরি জিনিশ, মনে হচ্ছে, ভুলে গেছি এবং দেখছি অনেক তুচ্ছাতিতুচ্ছ স্মৃতির আলোয় জ্বলজ্বল করছে। ঠিক কোন্ জিনিস কোন্ ভাবনা কিংবা কার মুখ অথবা কোন মুহূর্ত, আমাকে মনে করিয়ে দিল বাবার মৃত্যুর ইতিহাস সেদিন সেই রেস্তোরাঁয় তা আজ আর কিছুতেই বলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, যদিও বা কোনো কারণ বের করতে পারি, তা হবে কাল্পনিক, আমার নিজের সৃষ্টি করা। আমি কেবল এইটুকু বলতে পারি, কালোকফির ধোঁয়ায় যখন আচ্ছন্ন হয়ে গেল আমার চশমার কাঁচ তখন সেই চরম বিপ্লব ঘটে গেল আমার চিন্তার ভেতরে।
অথচ সেদিন রাতে গ্রামের সেই রুদ্ধশ্বাস অন্ধকার ঘরে, মা যখন আমার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিষের মতো কথাগুলো উচ্চারণ করলেন তখন এতটা লাগেনি। তখন কেবল একটা যন্ত্রণা হয়েছিল, যার পরিণতি হয় না। আমি যখন চলে এলাম–পরদিন সকালে আসতে পারিনি, ফিরোজা আমাকে আরো একদিন জোর করে রেখে দিয়েছিল–তখনো এত সহস্র হয়ে বাজেনি ঐ মৃত্যুর ইতিহাস। বরং আমার মনটা বেশ ভালোই ছিল পরদিন। ফিরোজা এসে বলল, চা পাইতে দেরি হইব। আমরা কেউ চা খাই না। বাজারে মানুষ পাঠাইছি।
আমার তখন মনে হলো, অকারণে, কিন্তু একটা বেদনার মতো, ফিরোজার স্বামী বোধহয় চা খেতেন রোজ সকালে। বললাম, রিয়াজ কই?
কে জানে?
পাঠিয়ে দিন না? বেশ হয়েছে দেখতে। পড়তে দেননি?
অর আবার পড়া। ফিরোজা ম্লান হেসে বলল, পইড়া যা করবো আমার জানা আছে। হালের। মুঠি না ধরলে ভাত জুটবো না। ঐ বই নিয়া মনে কইলে যায় ইস্কুলে।
অবাক হলাম ফিরোজার কথা শুনে। লেখাপড়ার দিকে এত বিতৃষ্ণা, আমি, হতে পারে জানতাম না। ছেলে হবে, এবং বয়স হলে স্কুলে যাবে, পাশ করবে, এইটেই আমার কাছে। স্বাভাবিক। হাল না ধরলে ভাত জুটবে না–এর মতো অসম্ভব যেন আমি আর কিছু শুনিনি। ব্যাকুল হয়ে বললাম, ছি ছি, এটা কী হলো? লেখাপড়া না শিখলে কেউ বড় হয়? টাউনে কেউ নেই?–মানে ওর বাবার মানে, শহরে থাকলে ওর লেখাপড়ার মন হতো। ভালো হতো।
ফিরোজা বলল, অর চাচারা নিতে চাইছিল। আমি দেই নাই। কী খাইবো, কী পরবো, চাচিরা নিজের থুইয়া পরের ছাওয়াল আপনা করবো কেন? পর আপনা হয় না, ভাই। একবারে এতিম হইয়া যাইতো রিয়াজ, নিয়া আসছি, আল্লা দিলে এমনি চলবো।
চোখে পানি এসে গিয়েছিল আমার। গতরাতে ভাবছিলাম, বললে রিয়াজকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম। সে কথাটাও বলতে পারলাম না। বললাম, ভারী সুন্দর হয়েছে ছেলেটা। ফিরোজা তখন চলে গেল।
বেলা বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে চনমন করে খিদেটা উঠল আমার। খেলাম প্রচুর। রিয়াজ আমার কোলের কাছে বসে পা ছড়িয়ে ভাত–তরকারি ঢেলে বাঘা বাঘা হাতে খেল। মা এসেছিলেন পরবেশন করতে। খোরশেদ সাহেব একটা মামলার তদবিরে ফজরের আগেই চলে গেছেন শহরে, ফিরবেন রাত্তিরে। তার সঙ্গে আমার সকালে দেখা হয়নি। যাবার কথা বলতেই মা মৃদুস্বরে আপত্তি করলেন এবং কারণ দেখালেন, ফিরোজার বাপ বাড়ি নাই। তুমি যাইবা, সে কী কইবো?
গত রাতের কিছুই যে আমার মনে নেই, এবং মনে থাকলেও তা দুঃস্বপ্ন বলেই ধরে নিয়েছি। এ বিষয়ে আমি এখন নিশ্চিত। কারণ, ঐ কথাগুলো মনে থাকলে আমি তখন হাসতে পারতাম না।
হাসছিলাম। মা আমাকে চোখ তুলে কৌতূহল ভরে একবার দেখলেন, দেখে চোখ নামিয়ে নিলেন আমার চোখ পড়াতে। দুজনেই বুঝতে পারলাম, অথচ কেউই বললাম না, তিনি আমাকে যেতে দিতে চান না, খোরশেদ সাহেব থাকলেও আজ সকালে আমার যাওয়া হতো