মা তখন আবার নতুন করে কাঁদতে বসলেন। কঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়ালেন অনিশ্চিতভাবে। তার কান্নাটাকেও মেকি মনে হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে, নিজের জন্যে নয়, আমার জন্যে নয়, এক অর্থহীন অভিনয়ের অঙ্গ হিসেবে কেঁদে চলেছেন তিনি।
কিন্তু আসলে আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছি। ওরকমভাবে কথাগুলো না বললেই পারতাম। কাল সকালেই তো চলে যাবো, কী লাভ হলো মনটাকে তেতো করে? আরেক মুহূর্ত হলে হয়ত আমিও উঠে দাঁড়িয়ে তার হাত ধরে ক্ষমা চাইতাম, কেঁদে ফেলতাম। চোখে পানি এসে গিয়েছে আমার টের পাচ্ছি। তার আগেই মা বললেন, মাইনষরে শান্তি দিলি না তুই। তুই তো কবিই। তুই কবি না? বাপেরে জানে মারলি, সে সম মনে আছিল না? এখন আইছস মায়ের জল্লাদ হইয়া? যে কথা কাউরে কই নাই, তাই আমি আইজ চিল্লাইয়া কমু। তর জন্যে আইজ আমার এই শাস্তি। তুই, তুই মারছস তর বাপেরে।
তাঁর চাপা চিৎকারে শিউরে উঠলো অন্ধকার। এক অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল আমার আত্মা। কালো একজোড়া হাত যেন এগিয়ে আসছে আমার দিকে। শুকনো গলায় ঢোক গেলার ব্যর্থ চেষ্টা করে জিগ্যেস করলাম, আমি, আমি মেরেছি মানে?
সে মানুষটা সাঁতার জানতো না। আজরাইল হইয়া আইছিলি তুই মনে নাই? গাঙের পাড়ে খাড়াইয়া আছিল, ধাক্কা দিয়া তারে ফালাইলি। ভরা বর্ষার ঢল থিকা আর সে উইঠল না। আমার কপাল ভাইঙা এখন আমারেই শাসাস? কমুই তো, তর সাথে আমার কিসের সম্পর্ক? আমি চিল্লাইয়া কমু।
একটা দীর্ঘ তীক্ষ্ণ তরবারি দিয়ে কে যেন আমার হৃদপিণ্ডটা উপড়ে নিয়ে চলে গেল। আমি আর্তনাদ করে উঠলাম।
৪. চশমার কাঁচ আচ্ছন্ন হয়ে গেল
আমার চশমার কাঁচ আচ্ছন্ন হয়ে গেল গরম কফির ধোঁয়ায়–ঠিক যে মুহূর্তে চুমুক দেবার জন্য মুখ নামিয়েছি, তখন।
এই জিনিসটা আমার খুব ভালো লাগত; এই বাষ্প লেগে দৃষ্টি শাদা হয়ে যাওয়া, বিন্দু বিন্দু জলকণার মধ্যে অণুর মতো রামধনুর রং দেখতে পাওয়া। আর সুগন্ধ, কালোকফির সাড়া জাগানো সুবাস। অন্যান্য দিন, এই রকম একা বসতাম আমি, কোনো রেস্তোরাঁয়, কালো কফির পেয়ালা নিয়ে, বিকেলে, ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে এয়ার কণ্ডিশনার থেকে, লোকেরা চলত মৃদু পায়ে, সুন্দরী মেয়েদের দেখা পাওয়া যেত। ভুলে যাওয়া এক উপন্যাসে পড়া নায়কের মতো আমি কালোকফি চুমুকে চুমুকে নিঃশেষ করতাম, যেন এমনি করেই সে নায়ক কাছে। পাচ্ছে তার মেয়েটিকে যে মেয়েটি ভালোবাসত কালোকফি। আমার অনেকদিন ইচ্ছে হয়েছে, নিশাতকে ঐ উপন্যাসের মেয়েটির মতো কালোকফির জন্যে পাগল হতে দেখি। কিন্তু আমার স্কুটারে চড়ার আনন্দও যেমন অর্থহীন কিংবা দুর্বোধ্য নিশাতের কাছে, তেমনি কালোকফির স্বাদটা। নিশাত কালোকফি একেবারেই খেতে পারে না। সরু করে ফেলে ঠোঁট বলে, হেমলক। বিষ।
আমি তখন হো হো করে হেসে বলি, আর আমি সক্রেটিস?
আহা। তার পায়ের কড়ে আঙুল। বলতে বলতে নিশাত ঢেলে নেয় দুধ। কালোকফির স্বচ্ছ মেহগনি রংটা ঘুরতে ঘুরতে বাদামি হয়ে যায়। আমার মনে হয়, আমার একটা আনন্দ ঐ পেয়ালার মধ্যে চামচের আবর্তনে বিষাদের চেহারা নিল।
ঢাকায় ফিরেছি সকালবেলা। স্টেশন থেকেই টেলিফোন করে দিয়েছি নিশাতের কলেজে। সন্ধ্যে সাতটায় দেখা হবে, মোহাম্মদপুর স্কুলের বোর্ডিং গেটে দাঁড়িয়ে থাকব আমি। এবং আজকেই ঠিক করে ফেলব বিয়ের প্রস্তাব করে কীভাবে পাঠানো যায়।
সিনেমার ব্যানারে বড় বড় মুখ। আমি অবাক হয়ে দেখছি। হাত ঘড়িতে স’পাঁচটা বাজে। হাসি পেল। বড় অধৈর্য হয়ে উঠেছি আমি: নিশাতের সঙ্গে অনেক কটা দিন এবং অনেকগুলো মাইল ভ্রমণের পর আজ আবার দেখা হবে, তাই আমার ভেতরটা লাগছে নতুন প্রেমে পড়া ছোঁকরার মতো–মাতাল, উদ্বেগে অস্থির; গলার কাছে নামহীন বাষ্পের পিণ্ড আর রক্তিম কর্ণমূল আমার।
বসলাম সেই রেস্তোরাঁটায় যেখানে নিশাতের সঙ্গে সে রাতে বসেছিলাম। নিশাত বলছিল, বাড়িতে মেহমান আসবে; আর আমি বলছিলাম, খানিকটা অভিমান করেই, বেশ তুমি খাবে তো খাবে না, আমি খাই, বসে বসে দেখো। নিশাত অবশেষে খেতে রাজি হয়েছিল। একজন বেয়ারা প্যাড পেন্সিল হাতে করে লিখে নিচ্ছিল আমাদের পছন্দ। গরম সুপের স্পর্শে নিশাত তার ঠোঁট কুঁচকে ফেলেছিল।
কফির জন্যে বললাম আমি। কফি এলো। চুমুক দিতে যাবে, তখন তার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল আমার চশমার কাঁচ। আর সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরটায় কী হয়ে গেল কিছু ঠাহর করতে পারলাম না, বিশ্ব–সংসারের চেহারাই যেন পালটে গেল এক নিমেষে। লুপ্ত হয়ে গেল চারদিকের ছবি, দেয়াল, মানুষ, কাউন্টার, আমার কফির পেয়ালা। চোখ তুলে দেখি, ভালো করে কিছুই দেখতে পারছি না আমি। ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে আমার কাঁচ, না, পৃথিবী আমার সমুখ থেকে বিদায় নিচ্ছে? হঠাৎ প্রচণ্ড কান্না হতে লাগল ভেতরে। নিজেকে নিঃসঙ্গ, বধির, পরিত্যক্ত মনে হলো। ভুলে গেলাম চশমার কাঁচ পরিষ্কার করলেই সব আবার দেখতে পাবো আমি। যেন পৃথিবী আমাকে চরমভাবে বঞ্চিত করে চারদিক থেকে হা–হা করে হাসছে আর আমি ডুবে যাচ্ছি।
কোথায় আমার আনন্দ? আমার কালোকফির প্রিয় স্বাদ? বাষ্পের মধুর স্পর্শ? আমি হত্যাকারী। বাবাকে আমি হত্যা করেছি। চোখের সামনে খাটো কালো কোট পরা বেয়ারাকে মনে হচ্ছে ব্যারিস্টার, আমার দিকে তর্জনী তুলে, দূরে কাউন্টারে, যেন বিচারকের উচ্চাসনে আসীন বিচারপতি ঐ নির্বিকার–মুখ ম্যানেজার, তাকে বলছে, এর চেয়ে ঘৃণ্যতম অপরাধ আর কী হতে পারে। পুত্র হত্যা করেছে পিতাকে। পিতা, যে পিতা মুখের অন্ন আর বুকের রক্ত দিয়ে মানুষ করেছে সন্তানকে।