এখানে, এ বাড়িতে আসবার পরমুহূর্ত থেকেই আমার মন যেন সহস্র চক্ষু হয়ে উঠেছে এইমাত্র সেটা টের পাচ্ছি। সব কিছুর মধ্যে খুঁজে পাচ্ছি অর্থ, সব কিছুকে নিজের অংশ করে তোলার প্রচণ্ড টান বোধ করছি। যেন এমনি করে আমার ব্যর্থতা, ক্ষয়, স্মৃতি সমস্ত কিছুর ওপরে গড়ে উঠবে অসামান্য সুন্দর সৌধ। আসলে সব কষ্টের মূলে রয়েছে মানুষের এই কষ্ট পাবার ক্ষমতাটা। আমার মন যদি পাথরের হতো, আমার চোখ যদি দৃষ্টির অতীতে কিছু না দেখতো, তাহলে চমৎকার দিন কাটতো আমার। কিন্তু কোথায় যে কবে কুড়িয়ে পেলাম এই স্বভাবটা ঘুরে ফিরে উলটে পালটে একটা ছবি, একটা মুহূর্ত, কী একটা অনুভূতিকে না দেখতে পারলে যেন শান্তি হয় না। নিশাত বলে, আমার আইন না পড়ে সাহিত্য কী দর্শন পড়া উচিত ছিল।
হয়ত আগাগোড়াই আমি ভুল করে এসেছি। জীবনে যা করা উচিত ছিল, যা করলে আমার সুখে সম্মানে দিন কাটতো, তা করিনি। ঝোঁকের মাথায় নিজেকে ছেড়ে দিয়ে মজা দেখার প্রবল ইচ্ছেটা যদি না থাকত, তাহলে আজ আমি আদৌ আসতাম না মাকে দেখতে। নিশাতকে যদি ভালো না বাসতাম তাহলে আসতাম না।
অথচ এমনিতে আমি খুব হিসেবি। অন্তত সবাই তাই বলে। জালাল এ নিয়ে আমাকে ঠাট্টা করে। জালালের বউ খোঁচা দেয়। নিজেকে যারা এমনি ক্রমাগত বিশ্লেষণ করে চলে তাদের কি সতর্ক পুরুষ বলে? বলে হিসেবি লোক? বৈষয়িক লোক?
মা-র ছবিটা কালো মনে হচ্ছে। মনটা খুব খারাপ। যে মহিলাকে দেখলাম ভরা মুখ, অলঙ্কারে আভরণে সম্ভ্রম ছড়ানো, ফর্শা তার সঙ্গে কিছুতেই মেলাতে পারছি না ছাব্বিশ বছর আমার স্বপ্ন–জাগরণে দেখা মাকে। খোরশেদ সাহেবের স্ত্রী হিসেবে তাকে কোনদিন ভাবতে পারিনি বলেই কী এই কষ্ট আমার? এই ছবি না মেলার দুঃখ?
কাল সকালেই চলে যাবো। এই সিদ্ধান্তটা নেবার সঙ্গে সঙ্গে মনের সমস্ত মেঘ যেন কেটে গেল, ভালো লাগল ভেতরটা। শীত শীত করছে। ফিরোজা ঠিকই বলেছিল। কথাটা টেনে নিতেই পুরনো সুতোব আচ্ছন্ন করা ঘ্রাণে ঘুম এলো। যেন পুরনো রোদ–বৃষ্টির গন্ধ সঞ্চিত হয়ে আছে এই কথাটায়। টুপটাপ করে শিশির পড়তে শুরু করেছে। চাঁদ ডুবে গেছে অনেকক্ষণ।
ঘুমের মধ্যে মনে হলো সুন্দর রোদের মধ্যে গা খুলে বসে আছি আমি। খুব আরাম লাগছে। হাত পা টান–টান করে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। চোখ মেলে দেখি, সেই মুখ, সেই অলঙ্কারের শব্দ, ফর্সা চাঁদের মতো। আমার মা।
চমকে উঠে বসতেই একেবারে বুকের মধ্যে পড়লাম গিয়ে তার। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। হাত বুলোতে গিলেন মাথায়, চুলের ভেতরে, আমার পিঠ ঘষতে লাগলেন যেন প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে আমার ওখানে।
সমস্ত ব্যাপারটা ঘটলো এক পলকের মধ্যে। আমার ঐ রোদের আমেজ থেকে তার কান্না পর্যন্ত। হতবাক হয়ে পড়ে রইলাম আমি। যেন স্বপ্ন দেখছি, আর কিছু না।
তারপর আস্তে আস্তে বোধ ফিরে এলো। টের পেলাম, রাত এখন অনেক। চোরের মতো মা এসেছেন আমার ঘরে। খুব করুণা হলো তাঁর জন্যে। ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে। তখন ফিসফিস করে মা জিগ্যেস করলেন, গ্যাদা আইছস ক্যান?
কী জবাব দেব এর? মা আবার নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। এত দূর মনে হলো তাকে যে বাধা দিতে পারলাম না। তিনি আবার জিগ্যেস করলেন, টাকা পয়সা দরকার? কয় ট্যাকা?
না, না।
আমি বিব্রত হয়ে পড়লাম তাঁর কথা শুনে। তিনি কি মনে করেছেন, টাকার দরকার পড়েছে বলে আমি এসেছি? পৃথিবীতে এত কথা, এত কারণ থাকতে, আমার মার কেন মনে হলো টাকার কথা? বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম তাঁর দিকে।
অন্ধকারে তাঁর মুখ দেখা যাচ্ছে না ভালো করে। চৌকির পর আধো উঠে বসেছেন, কোলে লুটিয়ে পড়েছে আঁচলটা। অদ্ভুত অর্থহীন কয়েকটা ভাজ সৃষ্টি হয়েছে আঁচলে। আমার চোখ স্থির হয়ে রইল সেখানে। যেন সমস্ত কিছুর ব্যাখ্যা লুকানো রয়েছে, আমার দৃষ্টি ওখানে খুঁজছে সেই চাবিকাঠি।
বললেন, ফিরোজার বাপ কত রাগ কইলো। কয়, ছাওয়াল আইছে ক্যান? কী চায় তারে জিগ্যাস করো নাই?
আমি কী ক্ষতি করেছি খোরশেদ সাহেবের যে তিনি না দেখেই আমার শত্রু হয়ে আছেন বুঝতে পারলাম না। মাত্র কয়েক ঘণ্টা হলো এসেছি, এর মধ্যে এত কথাই বা কখন হলো, তাও ঠাহর করতে পারলাম না। মনটা বিষিয়ে উঠল। তেতো গলায় বললাম, সে কথা তিনি জিগ্যেস করলেই পারতেন।
চুপ করে রইলেন মা। একটা নিঃশ্বাস পড়ল তাঁর। বললেন, তার মাথার উপর কত ঝামেলা–এত বড় সংসার যে কী কইরা চালায় তা সে জানে আর উপরে আল্লাহ জানে। আমার কথার পিঠে এ কথার মানেটা স্পষ্ট হলো না। আরো রোখ চেপে গেল আমার। দাতে দাঁত চেপে বললাম, টাকার দরকার, ছি-ছি, তাই হলে আপনার কাছে আসতাম না, ছাব্বিশ বছরে একটা খবর নিয়েছেন আপনি আমার? আপনাকে মা বলে কে? যান আপনার ছেলে–মেয়েদের কাছে। লজ্জা করে না লুকিয়ে আসতে? ভালো মানুষী দেখাতে?
আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না, কী ধরনের পরিস্থিতি হলে মানুষ তার মাকে এ রকম কথা বলতে পারে। আমি যদি নিজেই একথা শুনতাম, হেসে উড়িয়ে দিতাম একটা অলীক গল্প বলে। কিন্তু জীবনটা অলীকের ঊর্ধ্বে, অসম্ভবের হাতে, এক দুর্বোধ্য ঘটনা–প্রবাহ ছাড়া তো আর কিছুই নয়। তাই জীবন নতুন নতুন চমক দিতে পারে আমাদের।