সেদিন রাত্তিরের মধ্যে অনেকের সঙ্গে আমার দেখা হলো। মা, মার দ্বিতীয় স্বামী খোরশেদ সাহেব, তার আগের পক্ষের বিধবা বড় মেয়ে ফিরোজা আর তার ছেলে রিয়াজ; এ পক্ষের আমার সৎ ভাই–বোন আটজন। একে একে তারা এসে দাঁড়াল আমার সমুখে। চোখে তাদের অনিশ্চয় সন্দেহের ঠাণ্ডা দ্যুতি, দ্বিধার থরথর হাওয়া। বোনগুলো ছোট ছোট; তাদের গায়ের নীল কী হলুদ একরঙা কী ছোট ছোট প্রিন্ট ফুল করা জামা থেকে উঠছে জ্বালাকর গন্ধ, মুখে গৃহপালিত জন্তুর ছায়া। তার মধ্যে একজনের মুখ অবিকল আমার মতো। তার নাম জিগ্যেস করলাম, বলল না। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। যেন বুঝতে পারল না আমার কথা। ওদের বাবা তখন বললেন, অর নাম নীলা।
খানিকক্ষণ গল্প করে উঠে গেলেন খোরশেদ সাহেব। তার বুকের মধ্যে জমে থাকা কাশির প্রবল উঠে আসবার চেষ্টা আর খড়মের আওয়াজ অন্ধকারকে ঠুকতে ঠুকতে চলে গেল। যেমন শুনেছিলাম ঠিক তেমনি এই মানুষটা। যতটুকু না করলে নয় মেহমানকে, তার বেশি কিছুই পেলাম না তাঁর কাছ থেকে। পেলে কি খুশি হতাম? তাই কি আশা করেছিলাম? কী জানি। এটুকু কেবল মনে আছে, আমার বড় ভয় করছিল। যেন আমি একটা বিরাট অপরাধ করেছি এবং যে–কোনো মুহূর্তে তিনি তার কৈফিয়ৎ চাইতে পারেন, শাস্তি দিতে পারেন। চলে যখন গেলেন, স্বস্তি পেলাম।
ফিরোজা এলো। এসে বলল, বিছানা কইরা দিছি।
তারপর হাতের লণ্ঠনটা রেখে বলল, শ্যাষ রাইতে ঠাণ্ডা পড়ে। গায়ে দেওয়ার কিছু আনেন নাই?
আমি বললাম, তাই নাকি? নাতো।
খ্যাতা দেই একখান? বলে সে চলে গেল, হয়ত কাঁথা আনতে। তখন সুন্দর লাগল ফিবোজাকে। ও আমার কেউ নয়, আমার মা–র রক্ত নেই ওর শরীরে, অথচ আমরা ভাইবোন। শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল, যেন কোথাও কিছু আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, প্রবল মায়া করছে ফিরোজার জন্যে। কয়েক ঘণ্টা আগেও যাকে জানতাম না, যাকে দেখিনি, সে-ই যেন কতবালের চেনা মনে হচ্ছে। শ্যামল মুখ ওর চিকচিক করছিল আলোয়। নিরাভরণ বাহু, কণ্ঠ, কর্ণমূল যেন হাহাকার করছে। মনে হচ্ছে, ফিরোজার জন্যে কোন উপকার যদি আমি করতে পারতাম তো পরম শান্তি মিলতো।
পায়ের শব্দে ফিরোজাকে টের পেলাম। ভালো করে তাকাতে পারলাম না ওর দিকে। হাত বাড়িয়ে কাঁথাটা দিল ও। চুপ করে থাকা যায় না আর। বললাম, কে সেলাই করেছে? মা?
না, আমি।
চলে গেল না, দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে দাঁড়ি: হাসল নিঃশব্দে। বলল, আপনের কথা আম্মা একদিন কইছিল। আমি কই, বাঁইচা থাকলি একদিন দেখমু।
এলাম তো তাই।
রাইত হইছে, যাই।
আমার মায়ের জন্যে অবাক লাগছিল সবচে বেশি। এই যে মেয়েটা আমাকে কোনদিন দেখেনি, সেও কত আপন হয়ে উঠছে। অথচ মা এলেন না একবারও। যেন আমার আসা ফিরোজাদের জন্যে। দীর্ঘনিঃশ্বাসের সঙ্গে বুঝতে পারলাম ছাব্বিশ বছরে রক্তের সর্বশেষ ধারাটা নিঃশেষে শুকিয়ে গেছে, মরে গেছে বন্ধন, হারিয়ে গেছে স্মৃতি। এখন আর কিছুতেই আমি তাকে কাছে পাবো না, না তিনি আমাকে। আমার চলে যাওয়াই ভালো।
ভাগ্যি ভালো নিশাতকে বলে আসিনি কোথায় যাচ্ছি। তাহলে তাকে আর মুখ দেখাতে পারতাম না। ইচ্ছে থাকলেও অবশ্যি বলা হতো না। কারণ, ওকে বলেছি, আমার মা নেই। নিশাত–ফিরে গিয়েই নিশাতকে ডাকতে হবে। ওর ভাইজানকে বলতে হবে। বিয়ের তারিখটা ঠিক করে ফেলতে হবে।
আসলে, মরে গেলেই ভালো ছিল আমার। মা যদি সত্যি সত্যি মরে যেতেন তো এই ভীষণ আঘাতটা আমাকে পেতে হতো না। অন্ধকারে শুয়ে আছি, এখন তো আর নিজের মনের কাছে কিছুই লুকোনো সম্ভব নয়। আমি খুব আহত হয়েছি মা–র ব্যবহারে। কিছুতেই মেলাতে পারছি না, কী করে এমন হতে পারে? ছেলেকে রেখেও নির্বিকার মুখ করে চলে যেতে পারে মা? নাড়ির সঙ্গে টান থাকে নাকি মায়েদের। মিথ্যে কথা। আমি শুধু কল্পনাই করতে জানি, বাস্তব যে কত নিষ্ঠুর তা বুঝি না। যে মাকে মনে মনে কতদিন দেখেছি, তার একেবারে বিপরীত ছবি দেখে তাহলে আমাকে এত কষ্ট পেতে হতো না। পাগলের মতো ঢাকা থেকে এতদূর ছুটে আসার মতো বোকামিও করতাম না আমি।
বরং ফিরোজাকে আমার আপন মনে হচ্ছে। কেন মনে হচ্ছে কে জানে? আমি চাই না, তবু। তাই আরো রাগ হচ্ছে নিজের ওপর, আমার মা–র ওপর। আক্রোশে আঙ্গুলের ডগাগুলো লাল হয়ে উঠছে। উঠে পায়চারি করতে ইচ্ছে করছে আমার। রাত্রির নিস্তব্ধতা থেকে ঝি ঝি ডাকছে ঝিম–ঝিম ঝি–ঝি করে। থেকে থেকে একটা বাতাস দিচ্ছে। সারাদিন ট্রেন চলার ক্লান্তিতে নিস্তেজ নিরুৎসাহ লাগছে ভেতরটা। যেন আমি মরে যাচ্ছি। বা আজ রাতেই যাবো।
ফিরোজার কাছে মা আমার গল্প করেছিলেন বিদ্যুতের মতো মনে পড়ল কথাটা। কী বলেছিলেন যে, ফিরোজা ভেবেছিল, বেঁচে থাকলে আমাকে একদিন দেখবেই? হয়ত ফিরোজার ছেলে রিয়াজকে দেখে মনে পড়েছে আমাকে। হয়ত রিয়াজকে কোলে করে বসেছিল ফিরোজা, তখন আচমকা মা–র মনে হয়েছে আমার কথা। ফিরোজার যদি আবার বিয়ে হয়ে যায়, তাহলে রিয়াজ বড় হবে আমার মতো। তা কেন? নিজের ভাগ্য সবার কাঁধে চাপিয়ে দিতে চাইছি আমি। রিয়াজকে নিয়েই তো দ্বিতীয় সংসার করতে পারে ফিরোজা। হয়ত তারা খুশি হয়েই কোলে নেবে তাকে। মানুষ করবে নিজের ছেলের মতো। রিয়াজ কেন আমার মতো হতে যাবে? আমার মাথার কিছু ঠিক নেই। ফিরোজারই বা আবার বিয়ে হতে যাবে কেন? আমার মা ছিলেন গরিবের মেয়ে, রূপ ছিল, যৌবন ছিল হয়ত.–বোমার মতো বিপজ্জনক একটা বস্তু অভাবের সংসারে। তাই তার না হয় হয়েছে, ফিরোজার কেন হতে যাবে? আমাকে যদি দিত, আমি রিয়াজকে নিয়ে যাই ঢাকা। আমার কাছে থেকে পড়বে, বড় হবে। কাল বলব ফিরোজাকে? আশ্চর্য তো, ফিরোজা আমার কে?