কী বললেন?
জাহেদা ফিরে তাকাল তার দিকে। না, সে চোখে অশ্রু নেই। কখন সে মুছে ফেলেছে, কিংবা শুকিয়ে গেছে। পড়তি বেলায় স্নান আলোয় লাল অঙ্গারের মত দেখাচ্ছে সে মুখ। সত্যি কথা শুনবে? বাবর তাকে বলল।
বলুন।
তুমি যা করছি তা ছেলেমানুষেও করে না।
বারবার আমাকে ছেলেমানুষ বলার অধিকার কে আপনাকে দিয়েছে?
বাবরের মনে হলো গালে একটা চড় বসিয়ে দেয় মেয়েটার। কিন্তু তার বদলে সে হেসে ফেলল, অধিকার দেবার প্রশ্ন নয়। প্রমাণ করছ তুমি। নইলে বলতে না যে তোমাকে ফেলে যাচ্ছি। নইলে, এভাবে গাড়ি থেকে নামতে না এখানে।
মনে করেছেন, আমি খুব বিপদে পড়েছি?
না।
ভেবেছেন, আপনি আমাকে কিনে ফেলেছেন?
তাও না।
আমাকে যা খুশি তাই করতে পারেন ভেবেছেন?
তেমন কিছু ইঙ্গিত দিয়েছি কি?
কী হইছে ভাইসাব?
পেছনে হঠাৎ মানুষের গলা শুনে ফিরে তাকায় বাবর। দ্যাখে তিনটে লোক। হাতে লম্বা ছুরি, আর একরাশ কাঁঠাল পাতা। বোধহয় ছাগলের জন্যে কেটে নিয়ে যাচ্ছে।
মাঝখানের যুবক আবার প্রশ্ন করে, হইছে কী ভাইসাব কন না?
কী চাও তোমরা? বাবর জিগ্যেস করে।
কিছু না। একগাল হেসে বাঁ পাশের যুবক বলে, সোর শুইনা মনে করলাম কাইজা লাগছে। তাই জানিবার আইলাম।
কিছু নয়, যাও তোমরা।
তখন ডান পাশের যুবক বলল, আরে, পিকনিকে গেছিল বোধ করি পিরীতের মানুষ লইয়া, ফেরনের পথে আকাম করতে চায়।
মাইয়াডাও না।
বাবর হঠাৎ টের পায় সন্ধে হয়ে গেছে। দূরের কিছু ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। কোথা থেকে আজান ভেসে আসছে। আর সরসর করে বাতাস বইছে কাঁঠাল গাছের পাতায় পাতায়।
বাবর বলল জাহেদাকে, কি যাবে না। এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?
নারে মাইয়া যাইবার চায় না।
মাঝের যুবককে ঠেলা দিয়ে মন্তব্যটা করল বাঁ পাশের যুবক। তখন সে বলল, হ লাগে যেমুন তাই।
ডান পাশের যুবক বলল, চল যাইগা। শহুরা মানইষের তামশা দেখন লাগবো না।
বাবর বলল জাহেদাকে, চল।
বলে হাত বাড়িয়ে দিল জাহেদার দিকে। হঠাৎ সে হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল বাঁ পাশের যুবক।
কই লইয়া যান। দরকার হয়, ছেড়িরে আমরা পৌঁছাইয়া দিমু।
কিছু বোঝার আগেই বাবরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। বাধা দেবার আগেই গায়ে এসে পুড়ে মারের পর মার। আর অন্যজন চেপে ধরে জাহেদার মুখ। আরেকজন ফিসফিস করে বলে ওঠে, এই শালারে তুই ধইরা রাখা। আমরা কাম সাইরা লই।
বাবরকে যে মার দিচ্ছিল, ততক্ষণে বাবরের ওপর চড়ে বসেছে। সে এবার বলে, আর আমি, আমারে ভাগ দিবি না?
আমরা আগে লই, তারপর তুই লইস।
জাহেদাকে ওরা নিয়ে যায় কোলের মধ্যে ছাগলের বাচ্চার মত। সমস্ত ঘটনা ঘটে মাত্র আধ মিনিটে। কিংবা তারো কম সময়ে। চোখের একটা মাত্র পলকে। এর জনো তৈরি ছিল না বাবর। কিন্তু আশৰ্চয, তার কোনো দুঃখ হচ্ছে না, রাগ হচ্ছে না, বরং মনে হচ্ছে, এই-ই দরকার ছিল। মনে হচ্ছে, জাহেদার হাত থেকে সে এবার অতি সহজে বাচতে পারবে। তার হাসি পেল ভেবে যে লোকটা অহেতুক তাকে এত শক্ত করে ধরে রেখেছে। তাকে ছেড়ে দিলেও, সে চেঁচাবে না, পালটা আক্রমণ করবে না।
যুবক আরো দু চারটে ঘা লাগায় বাবরকে। বুকের ওপর ঘোড়ার মত চড়ে আছে। সে হঠাৎ একটু পাছা আলগা করে আবার সর্বশক্তিতে ধাপ করে বসে পড়ে। ঘোৎ করে আওয়াজ ওঠে। বাবরের; যুবক বলে, শালা, রসের ছেড়ি লইয়া বাইরইছ। একা খাইয়া বাড়ি যাইবা। ভাগ দিয়া যাইবা না সোনার চান।
আবার একটা ঘুষি লাগায় সে বাবরের গলার নিচে। খ্যাক করে থুতু ফেলে বলে, একটা আওয়াজ করবা কি জবাই কইরা ফালামু! ফিলিম স্টার হুসনার লাহান ছেড়ি পাইছি, ছাইরা দিমু না। সাতবার লমু। সামনে পিছনে সাতবার; একেকজন শালার ব্যাটা শালা। টাউনে তোমরা ফুর্তি করো। আর আমরা শালায় ছাগলের পাতা কাইটা মরি।
আবার একটা ঘুষি বসিয়ে দেয় সে বাবরের কণ্ঠার হাড়ে। তারপর ঘাড়ের গামছা দিয়ে মুখ বাঁধতে থাকে। চোখের সামনে যেন অন্ধকার হয়ে আসে সব বাবরের। সে কোথায় আছে, কেন আছে, সমস্ত বোধ হারিয়ে যেতে থাকে তার। একবাব যেন মনে হয়, জন্ম থেকে অনন্তকাল এমনি করে শুয়ে আছে সুদীর্ঘ শীতের মধ্যে অন্ধকার কাঁঠাল বনে এই লোকটাকে বুকে পাথরের মত নিয়ে।
সমস্ত অন্ধকারটাই যেন পাথরের মত চাপ বেঁধে আসে তাব চারপাশে। ক্রমশ এগিয়ে আসে। হৃদপিণ্ডের শব্দ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে আসে। যেন আর কোনো শব্দ নেই পৃথিবীতে, এই কাছে অথচ দূরে, ভেতরে কিন্তু বাইরে, দেখা তবু না দেখা জীবন স্পন্দনের জয়ঢাকা ছাড়া।
হঠাৎ সমস্ত শব্দ আর অন্ধকার ছিঁড়ে আর্তনাদ ফেটে পড়ে জাহেদার।
বা-বা।
বাবরের মনে হলো, স্পষ্ট সে শুনতে পেল কোনো বালিকা তার ছোট্ট জীবনের কার্নিশে দাঁড়িয়ে অতল গহবরে পড়ে যাওয়া থেকে পায়ের নখে সর্বস্ব আঁকড়ে ধরে প্রাণপণে একবার ডেকে উঠল।
দা-দা।
কোথা থেকে দানবের মত শক্তি এলো বাবরের। এক ধাক্কায় বুকে চেপে বসে লোকটাকে ফেলে দিয়ে সেই আর্ত চিৎকারের দিকে দৌড়ুল সে। চিৎকার করতে করতে দৌড়ল, হাসুন, হা-স-নু-উ।
দা-দা! আ-আ-আ!
হা-সু। ভয় নেই হাসু–উ।
নিচু গাছের ডালে ডালে ছড়ে যেতে লাগল বাবরের মুখ, হাত, কাঁধ। সে তবু দৌড়ুতে লাগল। আর বুক ফাটা ডাক দিয়ে খুঁজতে লাগল মেয়েটাকে।
বোনকে ফেলে আর কোনোদিন বাড়ি যাবে না বাবর।
তার বাড়ি আছে। বাড়িতে সবাই আছে। হ্যাঁ, সব তার আছে। আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।