কিন্তু এই যে এতক্ষণ সত্যি সত্যি চুপ করে আছে জাহেদা, এটা এখন ধীরে ধীরে অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ভাবছে কী মেয়েটা?
বাবর একবার আড়াচোখে তাকাল জাহেদার দিকে। না, কিছু বোঝা যাচ্ছে না। যে মেয়েকে সে নিয়ে এসেছিল। সে যেন অন্য কেউ।
সত্যি সত্যি তাকে ভালবেসে ফেলেছে নাকি? ভাবছে নাকি বিয়ের কথা! অত বড় বড় বক্তৃতা দিলাম যাবার পথে, সব পানিতে গেল!
শেষে আর থাকতে পারল না বাবর। নীরবতা ভেঙ্গে বলল, কি, একেবারে চুপ করে আছ যে!
জাহেদা চমকে তাকাল তার দিকে। এতক্ষণ পর শব্দগুলো যেন হাততালি দিয়ে পায়রা উড়িয়ে দিল হঠাৎ।
বাবর আবার বলল, পথে এত সাধাসাধি করলাম কিছু খেলে না পর্যন্ত। কী হয়েছে?
জাহেদা তবু কিছু বলল না।
বেশ, নাই বললে কথা।
বাবর ঘাড় কাত করে গাড়ি চালাতে লাগল। শিস দেবার চেষ্টা করল একবার, কিন্তু হলো না। ভালই লাগল না।
জাহেদা পরেছে। কালো রংয়ের পাজামা, আর শাদা জামা। বোধহয় তারি জন্যে মুখ দেখাচ্ছে কেমন পাণ্ডুর। একবার একটু মায়া করে উঠল বাবরের মনটা। পরক্ষণেই ঝেড়ে ফেলে দিল সে। ঢাকায় গিয়ে বাবলিকে আবার দেখতে হবে। বাবলি রাগ করলেও, রাগ তো আর হিমালয় নয় যে আছেও, থাকবেও।
হঠাৎ জাহেদা তাকে ডাকল, শুনুন।
আমাকে বলছ।
হ্যাঁ।
কী বল। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?
কেন, ঢাকায়। এই তো এসে গেলাম। আর এক ঘণ্টা। তার পরই তুমি পৌঁছে যাবে তোমার হোস্টেলে। গোট খোলা পাবে তো? কটায় যেন বন্ধ হয়;
না।
কী, না?
হোস্টেলে যাব না।
হেসে উঠল বাবর। বলল, তার মানে?
জাহেদা কোনো জবাব দিল না সে প্রশ্নের।
বাবর আবার জিগ্যেস করল, তাহলে যাবে কোথায়? কোনো বান্ধবীর বাড়িতে? ঠিকানা বল তবে?
না।
কী, না? ঠিকানা বলবে না? না, বান্ধবীর বাড়িতে যাবে না?
কারো বাড়িতে যাব না। দুষ্টুমি করছ?
না।
সত্যি বলছ?
হ্যাঁ।
তাহলে কোথায় যাবে শুনি?
আপনার বাসায়।
আমার বাসায়?
হ্যাঁ, আপনার বাসায়।
ছেলেমানুষ!
কেন?
আমার বাসায় কী করে যাবে?
যে করে আপনার সঙ্গে রংপুর গেলাম।
বলে জাহেদা সরাসরি তাকাল বাবরের দিকে। সে চোখের দৃষ্টি একরোখা নয়, কম্পিত— যেন দৃষ্টি জোড়া পেছনে পালিয়ে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়েনি বাবর। কিন্তু কোনোদিন কোনো কিছুই বাবরকে অপ্ৰস্তুত করতে পারেনি। বাবর কথা খোঁজার সময় নিতে হেসে উঠল। হাসির অবসরে ভাবতে লাগল, কী বলে।
বলল, রংপুরে গিয়েছিলে গাড়ি করে। গাড়ি করে আমার বাড়িতে অবশ্যই ফেরা যায়। কিন্তু ফিরতে পারা আর ফিরে যাওয়া কি এক কথা?
আমি কিছু বুঝি না।
জাহেদা জেদি মেয়ের মত মাথা নাড়তে লাগল ক্ৰমাগতঃ।
আমি কিছু বুঝি না।
তুমি ছেলেমানুষ।
আমাকে নিতে চান না। আপনার বাড়িতে?
নেব না কেন, যখন খুশি আসতে পার। কিন্তু এখন তুমি যাবে হোস্টেলে।
না।
আমি তোমাকে হোস্টেলে নিয়ে যাচ্ছি।
না।
হ্যাঁ।
না।
সন্ধে হবে এক্ষুণি। ঘরে যাবে, লক্ষ্মী মেয়ের মত ঘুমিয়ে পড়বে। আর যদি চাইনিজ খেতে চাও, পথে থামতে পারি।
না।
বাববার না বলছ কেন?
আপনি আমাকে ফেলে যাচ্ছেন।
বলেই জাহেদ আর নিজেকে সামলাতে পারল না। মাথা নামিয়ে নিল। ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। তার সারা দেহ। কান্নার শব্দ প্রবল হয়ে উঠল।
গাড়ি চালিয়ে চলল বাবর। সাভারের বাজার পেরিয়ে গেল এক্ষুণি। সট সট করে সরে গেল দোকানের ন্যাংটো বিজলি বাতিগুলো।
জাহেদার কান্না থামল না।
তখন ভীষণ রাগ হলো বাবরের। সে একটা সিগারেট ধরাল। শব্দ করে ফোঁস ফোঁস করে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল সে। ইচ্ছে করতে লাগল এখুনি কোথাও নামিয়ে দেয়।
না, কিছুতেই সে প্রশ্রয় দেবে না। তার কেউ নেই। কেউ হবেও না কোনোদিন। মানুষের যত জ্বালা এই মানুষে মানুষে অন্ধ বন্ধন থেকে।
হাঃ। খেলারাম।
চোখে স্পষ্ট দেখতে পায় দেয়ালে সেই অপটু হাতে বড় বড় করে লেখা–খেলারাম খেলে যা।
এই তার দর্শন, এই তার সত্য।
হঠাৎ যেন দম আটকে মরে যাচ্ছে এমনি শব্দ করে উঠল জাহেদা। যাক, মরে যাক।
না, আর পারা যাচ্ছে না। কান্না তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। বাবর সাঁ করে গাড়ি পাশে নিয়ে থামাল।
একদিকে স্তব্ধ নিস্তরঙ্গ মাঠ। আরেক দিক কাঁঠাল বন। কোথাও কেউ নেই। যেন এ গ্রাম ছেড়ে সমস্ত লোক কোথায় কবে চলে গেছে। এমনি যেন কবে, কোন অতীতে একবার দেখছিল বাবর–এমনি স্তব্ধতার মাঠ বন ভেঙ্গে সে হেঁটে যাচ্ছিল একদিন।
বাবর সিগারেট পিষে ফেলে জিগ্যেস করল, এখন বল, কাঁদছ কেন?
জাহেদা মাথা নাড়ল। সেটা তার কথার উত্তরে নয়, কান্নার অভিঘাতে।
বেশ, তবে কাঁদ। যখন থামবে, তখন বল, পৌঁছে দেব।
আপনাকে দিতে হবে না পৌঁছে।
জাহেদা দাঁড়াম করে গাড়ির দরোজা খুলে বেরুল।
আরে, দেখ, দেখ, পেছনে গাড়ি আসছে কিনা।
কিন্তু ততক্ষণে জাহেদা রাস্তা পেরিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। বাবরের একবার ইচ্ছে হলো, ফেলেই চলে যায়। জানে সেটা এক অসম্ভব অবাস্তব ভাবনা; কিন্তু মনের মধ্যে তাই নিয়েই খানিক নাড়াচাড়া করল সে।
তারপর সেও বেরুল।যতটা জাহেদাকে ফিরিয়ে আনবার জন্যে, তারচেয়ে বেশি। শরীর হালকা করতে। তার পর রাস্তা পেরিয়ে কাঁঠাল বনে নেবে একটা গাছ পছন্দ করে প্রশ্রাব করল। তারপর যখন শেষ হলো তখন চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে জাহেদা দূরে একটা গাছের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বাবর কাছে গিয়ে বলল, মেয়েদের এই সিনেমার ভঙ্গিগুলো আমি একেবারেই পছন্দ করি না।