আচার?
আরে না, না, আমের, তেঁতুলের আচার নয়। তোমার বাংলা পড়া থাকলে জানতে এ আচার মানে তোমরা যাকে ইংরেজিতে বল রিচুয়াল।
ও।
আচ্ছা, একটা ইংরেজি কবিতাই শোনাই। ইংরেজি মানে ইটালিয়ান ভাষায় লেখা। সিজার পাভিসের। পড়েছি ইংরেজি অনুবাদ। ইংরেজিটা ভাল মনে নেই। বাংলা করে বলি।
খানিক চুপ করে থেকে মনে করে নেয় বাবর। গাড়ির কাচ তুলে দেয় একটু। বাতাস এত জোরে কাটছে যে কথা হারিয়ে যেতে চায়। বলে শোন, সিজার পাভিসের কবিতাটা এ রকম–
সমস্ত কিছুতে হতাশ ঐ বুড়ো লোকটা
তার ঘরের চৌকাঠে বসে
দেখে চনমনে রোদে
মদ্দা আর মাদি একজোড়া কুত্তা–
তারা রক্তের নিয়মে খেলছে।
চোখ কালো করে তাকায় জাহেদা। বলে, কারা খেলছে?
মদ্দা আর মাদি একজোড়া কুত্তা। কুকুর। ডগস। রাগ কোরো না। ভাল কবিতা। আগে শোনাই তো।
মদ্দা আর মাদি একজোড়া কুত্তা–
তারা রক্তের নিয়মে খেলছে।
ভন ভন করে মাছি বুড়োটার ফোকলা মুখে;
বৌটা মারা গেছে বেশ কিছুদিন।
সে, আর দশটা কুক্তির মত,
জানতে চায়নি কিছু,
কিন্তু ছিল তার রক্তের নিয়ম।
বুড়োটা, তখনো তার দাঁতগুলো যায়নি,
এ ব্যাপারে পরম রসিক; রাত এলে বিছানায় যেত তাকে নিয়ে।
রক্তের নিয়ম, বড় সুন্দর।
জাহেদা বলে, থাক, শুনতে চাই না।
শোন, ভাল কবিতা। সিজার পাভিসের নাম শোননি?
কোনো দরকার নেই।
বাবর সে কথার জবাব না দিয়ে মনে মনে অনুবাদ করে মুখে আবার আবৃত্তি করতে থাকে–
কুত্তার জীবনে এই একটা চমৎকার দিক–
অফুরন্ত স্বাধীনতা।
সকাল থেকে সন্ধে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান :
কখনো একটু আহার :
কখনো একটু ঘুম :
কখনো একটা মাদি কুত্তার সওয়ার হলুম–
রাত না দিন, বিয়েই গেল!
শুঁকে দেখার স্বাভাবিকতায় সে চলে;
যা নাকে লাগে তাইই তার হয়ে যায়!
চুপ করুন। জাহেদা চেঁচিয়ে ওঠে না, মিনতি করে।
নিষ্ঠুরতা যেন আরো প্ৰবল হয়ে ওঠে বাবরের মনের মধ্যে। মেহ, দয়া, ভালবাসা। হাঃ! এ কীসের মধ্যে জড়িয়ে ফেলতে চায় তাকে জাহেদা? জানে না, বাবরের জানা আছে কী করে বেরিয়ে আসতে হয়! বেরিয়ে সে আসবেই। ভালবাসার জন্যে জাহেদাকে সে আনেনি। বাবর বাঁচে এক মুহূর্ত থেকে পরের মূহুর্তে। ছেলেবেলায় টেলিগ্রাফের এক খুঁটি থেকে আরেক খুঁটিতে ছুটে যাবার মত। সেই ভাবনাহীন খেলার মত।
বাবর বলল, এখনো কবিতাটা শেষ হয়নি জাহেদা। বাকিটা শোন।
না।
শোন।
না, না।
বেশ, তবে আমি নিজেকেই শোনাচ্ছি। তোমার ইচ্ছে না হয়, তুমি শুন না। তুলো থাকলে কানে দাও।
আমার কাছে তুলো থাকবে কেন?
মেয়েদের ব্যাগে তুলো থাকেই।
ভারি তো জানেন!
হ্যাঁ, মাসে মাসে তোমাদের দরকার হয় যে।
বাবর নিষ্ঠুর গলায় বলে। সব কিছু গুড়িয়ে দিতে চায় সে। তুচ্ছ করতে চায়। মেয়ে নয় তো, একটা চেন বাধা পশুকে যেন খোঁচাচ্ছে সে।
বাবর আবৃত্তি করে–
বুড়োটা ভাবে
একবার সেও ঐ কুত্তার মত
গমক্ষেতে করেছিল দিনের বেলায়।
এখন মনেও নেই কোন কুত্তির সাথে
কিন্তু মনে আছে
চড়া রোদ
দরদর ঘাম
আর অনন্ত অনন্ত পর্যন্ত করে যাবার ইচ্ছেটা।
অবিকল বিছানায় যেমন।
তাকে আবার অতীত ফিরিয়ে দিলে
সে করবে একমাত্ৰ গমক্ষেতে, দিনের বেলায়।
পথ চলতে চলতে
এক মেয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে গেল দেখতে।
মুখ ঘুরিয়ে গেলেন এক পাদ্ৰী!
রাস্তায় যা খুশি হয়!
এমনকি এক মহিলা–
পুরুষ দেখে চোখ নামান যিনি——
তিনিও দাঁড়িয়ে গেছেন দেখতে।
কিন্তু বালক,
ধৈর্যের অভাববশত
সে ছুঁড়তে লাগল ঢ়িল।
বুড়োটা ক্ষেপে গেল।
আবৃত্তি শেষে হা হা করে হেসে উঠল বাবর। আবার বলল, বুড়োটা ক্ষেপে গেল। কেন ক্ষেপে গেল জান জাহেদা? কারণ, সে বুড়ো হয়েছে, তার নিজের এখন সাধ থাকলেও সাধ্য নেই।
জাহেদা একবার দুহাতে মুখ ঢাকবার চেষ্টা করল নিজের। দুঃখে! কবিতার শৈলী সে জানতে চায় না, বুঝতে চায় না। তার ভীষণ কষ্ট হয়, বাবর কেন বেছে বেছে এই কবিতা শোনাল তাকে।
বাবর বলল, রাস্তায় ঘটনা। কী হচ্ছিল জান? ঐ যে কবিতায়, যা দেখে লোক দাঁড়িয়ে পড়েছে, এমনকি পাদ্রীটাও! একটা কুত্তা আর একটা—
চুপ করুন।
বাবর একটু থেমে ঘোষণা করল, সিজার পাভিস ওয়াজ এ গ্রেট পোয়েট। আমি কবি হলে ওর সব কবিতা অনুবাদ করে বই বের করতাম।
সাঁ করে গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করাল বাবর।
এখানটা নির্জন। দুপাশে আখের খেত। রোদে আকাশ পুড়ে যাচ্ছে। বিশ্বের স্তব্ধতা এখানে উপুড় হয়ে আছে।
গাড়ি থামতে দেখে জাহেদা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। কী বলবার জন্য রক্তিম ঠোঁট তার কেঁপে উঠল একবার।
হাঃ।
বাবর তাকে হঠাৎ দুহাতে জড়িয়ে ধরে, শক্ত করে বেঁধে, গ্ৰাস করে নিল জাহেদার ঠোঁট। আর জাহেদা তাকে দুহাতে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগল পাগলের মত। চিৎকার করতে চাইল। কিন্তু পারল না। তখন চোখ বেয়ে উষ্ণ অশ্রু হঠাৎ অবিরল ধারায় পড়তে লাগল তার।
ঠোঁট দিয়ে সে অশ্রুর স্বাদ নিতে নিতে বলল, চল ডাকবাংলোয় যাই। আমি আরেক বার তোমাকে ভালবাসতে চাই। ইংরেজিতে কথাটার যে আরেক মানে আছে, তাই, তাই আমি চাই।
২২. শুধু ভালবাসব
ঘরে ঢুকেই জাহেদাকে কোলে তুলে নিল বাবর। তারপর সোজা বিছানায় নিয়ে ফেলে দিল তাকে। ধপ করে পড়ল সে গরমকালের পাকা ফলের মত। ব্যথা করে উঠল পিঠে। কিন্তু বাবরের চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন শক্তিশূন্য মনে হলো তার নিজেকে। মনে হলো কোনোদিন এই লোকটাকে সে দেখেনি।