বাবর বলল, চলুন।
আর একটু খান।
আর না। সত্যি একটু বেশিই হয়ে গেছে।
এই বলে বাবর পকেট থেকে টাকা বের করল। খপ করে তার হাত ধরে ফেললেন কাজী সাহেব।
আরে, আরো করছেন কী? মাথা খারাপ? এখানে সব সাইয়ের কারবার বলে বেয়ারার হাত থেকে মেমো নিয়েই সই করে দিলেন কাজী সাহেব। বললেন, চলুন।
বাইরে বেরিয়ে তিনি বললেন, ভাবছেন, মাতাল হয়ে গেছি, না? গাড়ি চালাব কী করে?
কী যে বলেন?
চলুন, এমন আরামে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব যে, জানতেও পারবেন না। তারপর হঠাৎ আচমকা অপ্রাসঙ্গিকভাবে কাজী সাহেব বললেন, আমার জীবনটা খুব কষ্টে গেছে, জানেন? খুব দুঃখে মানুষ হয়েছি।
আর কিছু বললেন না। তিনি। বাবর কোনো উৎসাহ পেল না যে প্রশ্ন করে। তার মাথায় এখন লতিফার নাম, আর চোখে লতিফার ছবি। লতিফা নিজে বিয়ের কথা বলেছে, আশ্চৰ্য।
প্ৰচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি স্টার্ট নিল। অ্যাকসেলেটারে হঠাৎ বেশি চাপ পড়ে গিয়েছিল বোধহয়। বাবর সে কথা তুলে তাকে আর লজ্জা দিল না। পরে হঠাৎ বাবরের মনে পড়ল তার মেয়ের নাম সে বলেছিল বাবলি বাবর। নিজের কাছেই খুব মিষ্টি লাগছে নামটা। বাবলির সাথে নিজের নাম যোগ করার ফলে সুন্দর একটা সঙ্গীতের জন্ম হয়েছে যেন। বাবলি বাবর। ঢাকায় ফিরে বাবলির সঙ্গে দেখা করতে হবে। অনেক দিন দেখা হয় না। নাকি সেও এব। মধ্যে লতিফার মত না কয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে? আজকাল এই সব তরুণী মেয়েদের তাল বুঝতে পারে না সে। বয়সের দুযুগ ব্যবধান। কুড়ি বছর। কুড়ি বছর আগে কলকাতায় ছিল। সে আরেক জীবন। আর এক জগৎ।
এর আগে এতটা কোনোদিন ভাবেনি বাবর। লতিফার হঠাৎ চলে আসা তাকে রীতিমত ভাবিয়ে তুলেছে। কেমন একটা কষ্ট হচ্ছে কোথায়। না, ও কিছু না, সে ভাবল। আমি আজ খানিকটা বেশিই সুরা পান করে ফেলেছি। অতিরিক্ত সুরা পান করলে কখনো কখনো এ রকম রিক্ত পরাজিত মনে হয় নিজেকে।
ভাবনাটাকে পাশ কাটাবার জন্য কাজী সাহেবের দিকে মনোযোগ ফেরাল বাবর। দেখল, মিটমিট করে হাসছেন তিনি, চোখ পথের উপর স্থির নিবদ্ধ।
হাসছেন যে।
এমনি। আজি সন্ধ্যেটা বেশ কাটল।
চমৎকার।
আপনাকে খুব ভাল লাগে আমার। ঢাকায় আসুন না ছুটি নিয়ে। জমিয়ে গল্প করা যাবে কয়েকদিন।
আসব। এলে আপনাকেই প্ৰথম ফোন করব।
আপনি তখন আমার মেয়ের নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন না?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, কী যেন নাম?
বাবলি বাবর।
বাসার কাছে এসে গেল তারা। সদর ফটক বন্ধ। বাবর বলল, দাঁড়ান, আমি নেমে খুলে দিচ্ছি।
হাতঘড়ি আলোর দিকে ধরে কাজী সাহেব শীস দিয়ে উঠলেন।
এ-গা-র-টা বাজে। আমার আবার ভোরে অফিস কি-না। তাই দশটার মধ্যে শুয়ে পড়ার অভ্যেস।
সন্তৰ্পণে ফটকের ভেতর দিয়ে গাড়ি ঢুকিয়ে গ্যারেজে রাখলেন কাজী সাহেব। বাবর সেখানে দাঁড়িয়েছিল। কাজী সাহেব কাছে এলে বারান্দার দিকে এগুলি তারা। ওঠার সিড়িতে পা দিতেই নিশ্চল হয়ে গেল বাবর।
লতিফা দরোজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ঢিলেঢালা জামা পাজামা পরনে। আধা স্বচ্ছ নীল রং। চোখে ঘুমের ভাব। রোঁয়া ফোলান আদুরে বেড়ালের মত দেখাচ্ছে মুখটা। দৃষ্টিতে ভ্ৰকুটি। বাবর নিঃশব্দে একটু হাসল। তার কোনো জবাব দিল না লতিফা। তখন সে বলল, এই যে, জেগে আছ।
কাজী সাহেব বললেন, তোর মা কোথায়?
সে কথার কোনো উত্তর না দিয়ে একরোখা গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমরা গিয়েছিলে কোথায়?
বাবর সাহেবকে শহর দেখিয়ে আনলাম। অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছিলাম, তাই না বাবর সাহেব?
জি।
দরোজা ছেড়ে দিল লতিফা। ওরা ভিতরে ঢুকল। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। এখানে একটা বড় শেড দেয়া বাতি জ্বলছে মৃদু আলো ছড়িয়ে। ঐ কোণে চৌকি পাতা হয়েছে। তাতে কালো শাদা নকসা করা বেড কভার। বাবরের ভাবতে ভাল লাগল বিছানাটা লতিফা নিজ হাতে করেছে। সেদিকে তাকিয়ে সে বলল, অনেক কষ্ট দিলাম তোমাকে।
বিছানা আমি করিনি, মা করেছেন। বলে লতিফ বাবাকে বলল, খাওয়া হয়েছে তোমাদের?
নাহ্। বলে একটা সোফার ওপর ধাপ করে বসে কাজী সাহেব জুতো খুলতে লাগলেন।
কেমন একটা অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা সরসর করে যনে হেঁটে বেড়াচ্ছে। সেটাকে ঘায়েল করার জন্য বাবর একবার হাসবার চেষ্টা করল। গলা দিয়ে শব্দ বেরুল জং ধরা একটা মেশিনের মত।
নাক সরু করে লতিফা বাবার মুখের কাছে মুখ এনে ঘ্রাণ নিল।
তোমরা মদ খেয়েছ?
নাতো। না। এই একটুখানি। বলে অনাবিল হাসবার ভঙ্গি করলেন কাজী সাহেব।
লতিফা বলল, তোমাদের ভাত দেয়া আছে। খাবে এসো।
লতিফাকে দেখে মনে হচ্ছে বাবর যেন এ ঘরে নেই।
খাওয়া শেষে লতিফা জিজ্ঞেস করল, এতক্ষণ পর এই প্রথম বাবরকে, চা খাবেন? না, খেলে আপনাদের নেশা ছুটে যাবে?
সে যে একটা কথা অন্তত বলেছে এতে বড় স্বচ্ছন্দ বোধ করল বাবর। বলল, রাতে তো একবার চা খাওয়া আমার অভ্যোস কিন্তু তোমার যে কষ্ট হবে।
নিঃশব্দে চায়ের পানি গরম করতে গেল লতিফা।
কাজী সাহেব বললেন, আপনি কিন্তু বিয়েতে আসবেন।
আসব, আসব না কেন? লতিফার বিয়েতে আসব।
বাবর নিজেই টের পেল হুইস্কির ওজনে স গুলো সব শ হয়ে যাচ্ছে জিভেয়। চোর চোখে একবার সে তাকাল লতিফার দিকে। কিন্তু তার মনোযোগ কেতলি কাপের দিকে।
নিঃশব্দে চা খেলো ওরা। কাজী সাহেব মাঝখানে কী একটা প্রসঙ্গ তুলতে গেলেন। কিন্তু নিজেই কী বুঝে আর তুললেন না।
লতিফা বাবরকে দ্বিতীয়বার কথা বলল, আপনি তো ক্লান্ত, শুয়ে পড়ুন।