কোন ছেলেটা?
নামটা মনে নেই। তার বয়সী ছিল। লেখাপড়া করত না। বাপ ছিল বাজারের কুলি। ছেলেটাও ছোটখাট মোট বইতে। আর ফাঁক পেলেই কোমর থেকে বাঁশি বের করে বাজাত। তুতুর-তুয়া-আ-আ–এমনি একটা সুর ছিল। সেই সুরাটাই ঘুরে ফিরে বাজাত। তারপর একদিন সাপে কাটল তাকে।
নাঃ। কবে কোনদিন ভেবেছে বাবর? ভাববে না সে। সব ভাবনার গলা টিপে মেরেছে।
সে বহুকাল আগে। ভাবনা তার শুক্র। এই তো সে বেশ আছে, ভাল আছে।
লোকটা ফিরে এলো খুচরো নিয়ে। টাকা গুনে নিয়ে এগুল বাবর। পেটের কাছে টনটন করে উঠল তার। একটা ঝোপ খুঁজে হালকা হলো। এখান থেকে মন্দিরের চূড়া খানিক দেখা যাচ্ছে। রোদ পড়েছে সূচাল মাথায়। ময়রার দোকানে থরে থরে সাজান চৌকো সন্দেশের চুড়ার মত।
জাহেদা ঠিকই বলেছিল। মন্দির দেখা, রংপুরে আসা, একটা উপায় মাত্র। সে এসেছে অন্য কিছুর লোভে। সেটা তার পাওয়া হয়ে গেছে। আর কী দরকার? মন্দির থাক মন্দিরের ভিতে। আমি চলি।
বাবর বলল, হ্যাঁ চলি।
আবার সেই সাঁকো পেরিয়ে বাবর এলো গাড়ির কাছে। গাড়ির গায়ে মিহি ধুলোর পর্দা পড়েছে। কিন্তু জাহেদা নেই। গেল কোথায়?
চারদিকে চোখ চালিয়েও জাহেদাকে কোথাও দেখা গেল না। তখন একটু উদ্বেগ হলো। আরে, এ যে দেখছি সত্যি সত্যিই রাগ করেছে। বাবর জিগ্যেস করল, পাশেই চায়ের দোকানে। তারা বলল, পথ দিয়ে হেঁটে গেছে। কোনদিকে? পাকা সড়কের দিকে। মেয়েটা পাগল নাকি? হেঁটেই রওয়ানা দিল ঢাকায়?
বাবরের মনে হঠাৎ একরাশ স্নেহ ঝাঁপিয়ে পড়ল। না, সত্যি ছেলেমানুষ। এক মুহূর্তের জন্যে জাহেদাকে মনে হলো তারা যেন ছোট্ট একটা মেয়ে। গাড়িতে বসে মোটর স্টার্ট দিল বাবর। এখানো পাশে জাহেদার ক্ষীণ সুবাস টের পাওয়া যাচ্ছে। সুন্দর সুগন্ধ। সকালে জেগে উঠে। মনে করতে না পারা স্বপ্নের মত।
খানিক দূরে যেতেই চোখে পড়ল জাহেদাকে। একটা কালভার্টের ওপর বসে আছে উল্টো দিক মুখ করে। তার পূর্ণ টানটান পিঠ দেখা যাচ্ছে কেবল। আর মাথায় একরাশ চুল। গাড়ি থামাল তার পাশে বাবর। মেয়েটা তবু মুখ তুলে তাকাল না। বাবর হর্ণ দিল। তন্ময়তা ভাঙ্গল না। তখন নেমে এলো সে গাড়ি থেকে। সামনে দাঁড়িয়ে ডাকল, জাহেদা।
উত্তর নেই।
রাগ করেছ?
উত্তর নেই।
তখন বাবর বসল। তার পাশে। আরেকটা সিগারেট ধরাল। টানতে লাগল নিঃশব্দে। না, সেও কথা বলবে না। তার কেমন যেন মজাই লাগছে। এই ছোট্ট খেলাটুকু করতে।
সিগারেট শেষ হলে বাবর খুব কায়দা করে ছুঁড়ে দিল টুকরোটা। অনেক দূরে গিয়ে পড়ল। ধোঁয়া উঠতে লাগল পাকিয়ে পাকিয়ে। অল্প বয়সী ছেলে একটা যাচ্ছিল, সে হঠাৎ দেখতে পেল তা। যেন পথ চলতে সোনা পেয়ে গেছে, খুশিতে সে তুলে নিল সিগারেটের টুকরোটা। তারপর কষে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে লাফাতে লাফাতে চলে গেল।
হাসল বাবর।
হাসছেন!
না, তোমাকে নয়। ঐ ছেলেটাকে দেখে।
আপনি আমাকে কী মনে করেন?
বলে এমন করে জাহেদা বাবরের দিকে তাকাল বাবর একটা হালকা উত্তর দিতে যাচ্ছিল; থমকে গেল। একেবারে নতুন লাগছে জাহেদাকে। নতুন চেহারা। অর্থটা যেন ভাল বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু মনের মধ্যে টের পাওয়া যাচ্ছে। ভালবাসা? জাহেদা কি তাকে ভালবেসে ফেলেছে? একটা মানুষের ওপর জীবনের দায় দিলেই এমন দৃষ্টি ফুটে উঠে দু চোখে।
না না। ভালবাসা নয়। আমি কাউকে ভালবাসি না; কাউকে না। ভালবাসা বিশ্বাস করি না। এ হতে পারে না। এ আমি চাই না।
বাবর মাথা দোলাতে লাগল।
অসম্ভব; হতে পারে না।
মুখ থেকে কথাগুলো বেরিয়ে পড়ে তার।
জাহেদা ফিরে তাকায়। জিগ্যেস করে, কী হতে পারে না?
কিছু নয়। আসলে কী জান, আমার একটা বস্তুর অভাব বড় বেশি! শুনবে?
জাহেদা তাকিয়ে থাকে।
বাবর বলে, ধৈর্যের অভাব। বাবর মনে মনে বলে, না, আমাকে ফেরাতেই হবে। ভালবাসার সেই হাওয়া যদি বইতে থাকে, যদি সে বইতে দেয়, তাহলে তা ঝড় হয়ে দাঁড়াবে। কিছুতেই সে তা হতে দিতে পারে না। তাকে ফেরাতেই হবে।
বাবর ওর হাত ধরল। বলল, চল গাড়িতে যাই।
প্ৰায় টানতে টানতে গড়িতে এনে বসাল তাকে।
সমস্ত কিছু ভেঙ্গে দেবার আক্রোশ ফুসতে থাকে। বাবরের মনের মধ্যে। গাড়ি চালাতে চালাতে সে কথা খুঁজতে থাকে। এমন কথা, যা গুড়িয়ে দেবে ঐ হৃদয় দিয়ে হৃদয় অনুভব করবার মিথ্যে সাঁকোটা।
বাবর হঠাৎ টের পায়, জাহেদা তার ঊরুতে একটা হাত রেখেছে। সে হাত আমন্ত্রণের নয়, আশ্রয় সন্ধানের।
আরো শঙ্কিত হয়ে ওঠে বাবর। জাহেদা তাকে ভালবেসে ফেলেছে।
তাই তুচ্ছ হয়ে গেছে তার কাছে মন্দির দেখা। এখন তার পৃথিবী কেন্দ্রীভূত হয়ে এসেছে বাবরকে ঘিরে। এ কী হলো? এ রকমটা তো সে চায়নি।
মেয়েটা কি আশা করেছে, এখন সে একটা প্রেমের গান গুন গুন করবে, না, রবি ঠাকুরের একটা কবিতা আবৃত্তি করবে, যেমন সব মেয়ে স্বপ্ন দেখে উপন্যাস আর সিনেমার কল্যাণে।
বাবর হঠাৎ বলে, শুনবে একটা কবিতা?
মনে মনে আবছা একটা নিষ্ঠুরতা অনুভব করে বাবর।
শুনবে?
জাহেদা মুখে কোনো উত্তর দেয় না। কিন্তু বোঝা যায়, শুনতে কোনো আপত্তি নেই তার। মনে মনে হাসে বাবর। ঠিকই সে ধরতে পেরেছে। জাহেদা প্রেমে পড়েছে তার। হাঃ।
বাবর বলে, রবি ঠাকুরের শেষের কবিতায়— মনে আছে শেষের কবিতার কথা কাল না। পরশু তোমায় বলছিলাম?
হ্যাঁ।
সেই শেষের কবিতা যে কী করে গেল, কবিতা শোনান হয়ে দাঁড়াল একটা আচার।