বলেছিল। ঠাট্টা করে। কিন্তু বলেই সে বোঝে, বলাটা ঠিক হয়নি। লজ্জা করে তার। সারা শরীর খুস খুস করে উঠে জাহেদার। নিজেকে নগ্ন মনে হয়। হঠাৎ। লুকোতে ইচ্ছে করে। চলছিল সে বাবরের আগে আগে, হঠাৎ গতি শিথিল করে ফেলে সে, কিংবা হয়ে আসে আপন থেকে।
আর বাবরের মাথায় মুহূর্তে একটা রক্তবর্ণের ফুল ফুটে। খেলে যা, খেলারাম, তুই আবার খেলে যা।
ইচ্ছে করে, সত্যি সত্যি জাহেদাকে কোলে করে তার ধুলো পায়ে মুখ দিয়ে দেখে। নাভির কাছে কোমল উষ্ণতা আবার ফিরে আসল বাবরের। এতক্ষণের সেই ভার যেন নেমে যায়। হালকা লাগে নিজেকে। নাহ, সে যে ভাবছিল, ভেতরে একটা কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে তার, তা বোধহয় সত্যি নয়। সে যা ছিল তাই আছে।
খেলারাম, খেলে যা।
বাবর তার দৃষ্টি দিয়ে সমস্ত কাপড় যেন খুলে নেয় জাহেদার। আবার বেরিয়ে পড়ে তার গোলাপি নরম স্পন্দিত মাংস।
দাঁড়িয়ে পড়লেন যে!
জাহেদা জিগ্যেস করে। তখন চৈতন্য হয় বাবরের।
আবার হাসছেন!
হাসিটা আরো দীর্ঘায়িত করে রাখে বাবর। তারপর বলে, সত্যি মন্দির দেখা কিছু নয়। তুমি ঠিকই বলেছ।
তার মানে?
আবার আমার ইচ্ছে করছে। এখুনি। এখানে।
জাহেদা ভ্রুকুটি করে।
সত্যি, এখানে যদি আমাদের শোবার ঘরটা কেউ মন্ত্রবলে উড়িয়ে আনতে পারত জাহেদা। যদি সেটা সত্যি হতো।
চলুন, মন্দির দেখতে যাই।
মন্দির হলো ভেতরের আঙ্গিনায়। বাইরে বিরাট মাঠ পেরিয়ে যেতে হয়। সেই মাঠে, গাছতলায় অসংখ্য মানুষের ভিড়। এরা এসেছিল মেলায়। এক জায়গায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গোল হয়ে বসেছে কলাপাতা নিয়ে। ভাত রান্না হয়েছে মাটির হাঁড়িতে। মা সেই ভাত, গরম ধোয়া ওড়ানো লাল চালের ভাত উপুড় করে ঢেলে দিচ্ছে কলার পাতে। পাশে ওদের বাবা বসে আছে চোখ রক্তবর্ণ করে। সারারাত গাঁজা খেয়েছে নিশ্চয়।
জাহেদা অবাক হয়ে যায়। বলে, এই ধুলোর মধ্যে পাতায় করে ভাত খাবে নাকি ওরা?
হ্যাঁ খাবে।
এহ মা।
সারা শরীর ঝাঁকিয়ে ওঠে যেন জাহেদার। বাবার জিগ্যেস করে, কী হলো তোমার? কী হলো?
মনে হচ্ছে আমারই দাঁতে বালি লেগেছে।
দেশের প্রায় সব মানুষেই এইভাবে খায়।
মাটিতে?
হ্যাঁ মাটিতে। তবু তো খেতে পাচ্ছে ওরা, অনেকে তাও পায় না।
আচ্ছা ওরা সঙ্গে করে প্লেট আনতে পারে না।
হা হা করে হেসে ওঠে বাবর।
হাসির কী হলো?
তোমার কথা শুনে ফ্রান্সের সেই রাণীর কথা মনে পড়ে গেল।
ঠাট্টা করছেন?
না। সেই রাণী বলেছিল, সব ক্ষুধার্ত মানুষ দেখে, ওরা রুটি নেই তো, কেক খায় না কেন?
এ আপনার বানানো গল্প। শুধু শুধু আমাকে ঠাট্টা করবার জন্যে। বলুন, বানানো নয়?
হ্যাঁ, বানানো। বাবর মিথ্যে করে বলল। তারপর বলল, চল এগোই।
আরেকটা গাছের তলায় তখনো একজন বসে আছে রুদ্রাক্ষের তৈরি মালা নিয়ে। বিক্রি করছে।
কত করে?
আট আনা।
মাত্র আট আনা! জাহেদার চোখ হঠাৎ খুশিতে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। এত সুন্দর জিনিস। বলে, গলায় পরে বেরুলে এত মানাবে। আমি কিন্তু এক ডজন নেব।
এক ডজন?
হ্যাঁ, পাপ্পুকে দেব, শরমিনকে দেব, সবাইকে দেব।
কেনা হলো মালা। বাবর দাম দিতে যাচ্ছিল, বাধা দিল জাহেদা। বলল, না। আমি দেব। আপনার কাছে পয়সা নেব কেন?
আমার কাছে শুধু চুমো নিও তুমি!
সত্যি সত্যি রাগ করে এবার জাহেদা। বলে, আপনি শুধু ঐ এক কথা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেন না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। আমাকে কী মনে করেন? দেখব আপনার মন্দির।
মন্দিরটা আমার নয়।
বাবরের ঠাট্টা যেন আরো জ্বলিয়ে দেয় জাহেদাকে।
আপনার মন্দির, আপনিই দেখুন।
মুহূর্তে জাহেদা ফিরে লম্বা পা ফেলে দৌড়ুতে শুরু করল। ফিরতি পথে। হঠাৎ করে এমন রাগ করবে বুঝতে পারেনি বাবর।
আরে, কী হলো শোন।
বাবর তার পেছনে তখন দৌড়ুল তাকে ধরতে। ভাত ফেলে সেই ছেলেরা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। রুদ্রাক্ষের মালা যে বিক্রি করছিল সেও এবার উঠে পেছন থেকে দৌড়ুতে দৌড়ুতে ডাকতে লাগল।
ডাক শুনে তাকাল বাবর। আরে, ওকে দামটা দেয়া হয়নি। পকেটে হাত দিল বাবর। বিরক্ত কণ্ঠে জিগ্যেস করল, কত দাম?
ছয় টাকা।
কিন্তু সঙ্গে দশ টাকার নোট। লোকটার সাথে ভাংতি নেই। কী মুশকিল। বাবর তাকিয়ে দেখল, জাহেদাকেও এখন আর দেখা যাচ্ছে না। কী করবে। সে? দশ টাকার নোটটাই দিয়ে দেবে? না, আরো আটটা মালা নিয়ে পুরো করবে টাকাটা? জাহেদা ভীষণ রাগ করেছে নিশ্চয়। নিজেকে ভেতর থেকে খারাপ লাগছে বাবরের। ছোট্ট একটা মেয়ে হঠাৎ করে খেপে গেলে বাড়িশুদ্ধ মানুষ যেমন আদর করে থামাতে অস্থির হয়ে ওঠে, তেমনি লাগছে তার।
জাহেদার চলে যাওয়া পথের থেকে চোখ ফিরিয়ে বাবর যখন লোকটাকে দশ টাকার নোটটাই দিতে তৈরি, তখন দেখে লোকটা নেই।
আরে, এ আবার গেল কোথায়?
দু একজন মানুষ তখন দাঁড়িয়ে গেছে বাবরের পাশে। তাদের একজন বলল, ভাংতি আনতে গেছে।
নিঃশ্বাস ফেলল বাবর। বড় করে একটা নিঃশ্বাস। কিছু করবার নেই। দাঁড়াতেই যদি হয়, দাঁড়াবে সে। ভাবনা করে লাভ নেই।
জাহেদা হেঁটে ঢাকা ফিরে যাবে না, গাড়িতেই গিয়ে বসবে। এত ভেবে কী হবে? কবে কোনোদিন এত ভেবেছ বাবর?
হাসল বাবর। নিজের দিকেই তাকিয়ে সে হাসল মনে মনে। খেলারাম, খেলে যা। তোর কাজ শুধু খেলে যাওয়া হাঃ।
একটা সিগারেট ধরাল বাবর। ধুলো পায়ের পথ দেখতে লাগল। পাতা ঢাকা। ভিজে ভিজে। যেখানে ছায়া, সেখানে ভারি সুন্দর ঠাণ্ডা। যেন সারা জীবন শুয়ে কাটিয়ে দিতে লোভ হয়। কানে যেন বাঁশির সুর শুনতে পায় বাবর। সেই ছেলেটা খুব ভাল বাঁশি বাজাত।