আাব্বাসের মা কে?
চাচার বাড়িতে কাজ করত। মাঝ বয়সী। বিধবা। আব্বাসকেও আমরা কোনোদিন দেখিনি, তিনি মাঝ বয়সেই নাকি মারা গিয়েছিল। গোলমত মুখ, শ্যামল, ঘন ভ্রু ছিল মনে আছে আব্বাসের মা-র। আর মনে আছে পায়ের তোলো ঘেয়ো শাদা ছিল তার। সারাদিন মাঢ় দিয়ে কাপড় কাচতে হতো, তাই। সন্ধ্যের সময় দেখতাম কাঠ পুড়িয়ে ধোঁয়া দিত পায়ে।
কেন?
ওটা ঘায়ের ওষুধ। লালচে একটা দাগ হয়ে যেত পায়ের চারদিকে অনেকটা আলতার মত।
আলতা কী?
ও চিনবে না। এককালে বাংলার মেয়েরা শখ করে পায়ে পরত। আরো আগে নাপিত বৌ চুবড়িতে করে আলতা নিয়ে আসত বাড়ি বাড়ি, বৌদের পায়ে দিত। দেখি, ঢাকায় ফিরে, খুঁজে তোমাকে এক শিশি আলাতা কিনে দেব। এখনো হয়ত পাওয়া যায়। তোমার পায়ে চমৎকার লাগবে।
বাবর পা দিয়ে জাহেদার পা ছুঁয়ে দিল। জাহেদা পা টেনে বলল, আপনার শুধু প্রমিজ আর প্রমিজ। তারপর গল্পটা কী হলো?
গল্প নয়। সত্যি। একেবারে চোখে যা দেখেছি। সেদিন সারা বিকেল সারা সন্ধে কেন যেন গা ছমছম করতে লাগল আমার। মগরেবের নামাজ পড়লাম চাচার সঙ্গে, কিন্তু ভাল করে তার মুখের দিকে তাকাতে পারলাম না। রাতে দেখলাম, চাচা চোখে দিচ্ছেন সুরমা। আমি তাকাতেই কেমন তড়বড়ে গলায় চাচা বলে উঠলেন, চোখ ভাল থাকে, তুই ঘুমো!
তারপর?
আহ অতি উতলা হয়ে না।
জানেন। আপনার দোষ কি?
বলতে গেলে একটা বই হয়ে যাবে। তোমার কোনটা চোখে পড়েছে তাই বল।
আপনি গল্প বলেন এত ঘুরিয়ে যে আসল কথাই হারিয়ে যায়।
আচ্ছা, আচ্ছা। তারপর পড়েছি ঘুমিয়ে। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে যেন মনে হলো, পানির শব্দ। খুব সরু করে পানি পড়ছে কোথাও। যেন রাতের অন্ধকারের মধ্যে একটা তরল শব্দ পথ করে চলেছে। আস্তে আস্তে ঘুম ভেঙ্গে গেল। তখন টের পেলাম, পানি গড়াচ্ছে আমাদের আঙ্গিনায় এক কোণে যে পোসলখানা, তারই পাকা ড্রেন দিয়ে, গিয়ে পড়ছে বাইরে। কেউ গোসল করছে। কান খাড়া করে রইলাম। কে? কে এত রাতে গোসল করে। অনেকক্ষণ পরে দেখি, চাচা! গোসল করে চাচা এলেন। ভারি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কেমন খাপছাড়া ঠেকেছিল সে রাতেই, সেই ছেলে বয়সেই। এত রাতে কেন চাচা গোসল করবেন? কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি–
আর আমি এখনো বুঝতে পারছি না, আপনার এতে এত চমকাবার কী ছিল।
ছিল না? শোন তাহলে। চাচা সে রাতে আব্বাসের মাকে নিয়ে ঘুমিয়েছিলেন।
জাহেদা কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কথাটা যেন পুরোপুরি, উপলব্ধি হলো তার। চট করে সামলে নিল নিজেকে। একেবারে চুপ করে গেল।
কী, কথা বলছ না?
জাহেদা তবু কিছু বলল না।
বাবর বলল, তাই বলছিলাম, চরিত্র বলে যা আমরা জাহির করি আসলে তা কতটা খাঁটি সত্য সেটা বিবেচনার বিষয়। আমার তো মনে হয়, সব মানুষেরই দুটো চেহারা। একটা তার নিজের, আরেকটা সে তোলে অপরের জন্যে।
আপনারও?
তার মানে?
আপনারও দুই চেহারা?
এবার থমকে গেল বাবর। একটু হাসল। কী বলবে গুছিয়ে নিতে চাইল মনের মধ্যে। এক লহমা পর বলল, হ্যাঁ আমারও। আমাকে তুমি যা জান, আমি তা নাই।
০. হাসু, হাসনু, হাসুরে
হাসু, হাসনু, হাসুরে।
তীব্র আর্তনাদের মত তার নিজেরই সে ডাক যেন কানে শুনতে পায় বাবর।
হাসুরে।
মুখ খানা কেমন ছিল হাসনুর? পথের দিকে চোখ রেখেই চোখ তীক্ষ্ণ করে বাবর ভাবতে চেষ্টা করে। যেন নিজেরই সঙ্গে একটা মল্লযুদ্ধ চলতে থাকে তার। কিছুতেই সে পারছে না জয়ী হতে, কিছুতেই পারছে না। মনে করতে, কেমন ছিল দেখতে হাসু।
হাসু সন্ধেবেলায় পড়তে বসে বড় বিরক্ত করত।
পড়া বলে দেনা দাদা।
চুপ কর।
দেনা তোর পায়ে পড়ি।
যাবি তুই।
একটুখানি বলে দে।
মারব এক চাপড়।
তখন মুখ ভেংচে দৌড় দিত হাসনু।
হ্যাঁ, মনে পড়ছে। মুখ ভেংচালে ভারি মিষ্টি লাগত হাসনুকে। আদর করতে ইচ্ছে করত। কিন্তু তখন আদর করলে একটু আগে রাগ করবার মানে থাকে না নিজের। তাই সে পেছনে থেকে চেঁচিয়ে বলত, আবার আসবি তো তোর বেণি কেটে দেব; তখন মজা টের পাবি।
বাবরের চোখ যেন ভিজে আসে।
জাহেদাই এবার বলে, আপনি চুপ করে যে!
এটা বিশ্বের কি খুব অস্পষ্ট ঘটনা?
মানে?
আমার চুপ করে থাকাটা?
জাহেদা অবাক হয়। কেমন যেন টের পায় কোথায় একটা তার ছিঁড়ে গেছে।
বাবর যেন এখানে থেকেও নেই। সাহস হয় না ঘাটাতে। কাল রাতের পর এই প্ৰথম জাহেদা টের পায়, তার শক্তি যেন কে শুষে নিয়েছে। আগে যেমন চট করে একটা কিছু করবার কথা ভাবতে পারত, এখন যেন সেই ঝোঁকটা নেই। বরং খানিক ভেবে দেখার টিলেমি এসেছে।
জাহেদা বলল, যাচ্ছি কোথায়?
বর্ধমানে।
বলেই সামলে নিল বাবর। বলল, ঠাট্টা করছিলাম। যাচ্ছি কান্তনগরের মন্দিরে দেখতে।
তোমায় নিয়ে যাব বলছিলাম। এই তো প্ৰায় এসে গেছি।
খানিক পরেই হাতের বাঁয়ে লাল মাটির কাঁচা রাস্তা।
বাবর নেমে এক লোককে জিগ্যেস করল, এই পথেই তো মন্দির?
হ্যাঁ, সোজা চলে যান।
গাড়িতে এসে আবার স্টার্ট দিতে দিতে বাবর বলল, এখনো পথটা মনে আছে। ভুলিনি। চমৎকার মন্দির। পোড়া মাটির ফলকে তৈরি। এমনটি আর কোথাও নেই। অথচ জান, দেশের এত পুরনো, এত বিশিষ্ট একটা জিনিস, কারো খোঁজ নেই। খোঁজ নিতে গেলে ইনফরমেশনের লোকেরা বলবে, মুসলমান হয়ে হিন্দুর জিনিসে অতি উৎসাহ কেন? লাগাও টিকটিকি। ভারতের দালাল নয় তো!
দালাল মানে?
তাও জান না। বাংলায় জন্ম, থাক এদেশে, দালাল চেন না? ঐ ইংরেজিতে যাকে বলে এজেন্ট। ধান-চাল ওষুধ পত্তরের এজেন্ট নয়–এজেন্ট।