তারপর শোন। সীতাকে নির্বাসন দিয়ে রামের অন্তরে সুখ নেই। বিমর্ষ দিন কাটতে লাগল তার। শরীর কৃশ থেকে অতিকৃশ হয়ে গেল। মলিন হলো উজ্জ্বল ক্লান্তি। তখন অনুতপ্ত প্ৰজারা রামের তুষ্টির জন্যে রাজ্যের সেরা কারিগর দিয়ে সীতার একটা স্বর্ণমৃতি বানিয়ে রামের সামনে আনল। বলল, এই নিন। আপনার সীতা। রাম তখন প্রশ্ন করল, তোমার এই সোনার সীতা কি কথা বলতে পারে? উত্তর এলো, না। কানে শুনতে পায়?–না। —সে কি চোখে দেখতে পায়।–না, তাও পারে না। তখন রাম বলল, হোক না সোনার তৈরি, হোক না সেরা কারিগরের সৃষ্টি, চাই না। আমি এই সোনার সীতা, চাই না।
সুন্দর। জাহেদার গাঢ়স্বরে ঐ একটি মাত্র শব্দ শোনা গেল।
হ্যাঁ সুন্দর। এবং সত্যি। আমার মনের কথাই রামের মুখে শোনা গেছে। আমি যাকে চাই রক্তমাংসে চাই তাকে। সপ্ৰাণ তাকে চাই। জীবন্ত তাকে চাই। এই তুমি যেমন তেমনি করে চাই।
জাহেদা সমুখে তাকিয়ে রইল অঙ্কিত একটা চিত্রের মত।
কী ভাবছ?
না, কিছু না।
নিশ্চয়ই কিছু ভাবছ। বাবর প্রীত মুখে উচ্চারণ করল জোর দিয়ে।
জাহেদা তখন নিঃশব্দে এক টুকরো হাসল।
বাবর বলল, তুমি ভাবছ, এ কেমন কথা বলছি আমি। নয়? ভাবছ, তাহলে মানুষের মন কিছু না? শরীরটাই সব? এতকাল যা জেনে এসেছ তা ভুল? এই ভাবছ তো?
আপনার কী দোষ জানেন?
কী?
আপনার দোষ, নিজেই বলে চলেন, অন্যে যে অন্য কিছু ভাবতে পারে, অন্য কিছু বলার থাকতে পারে তার, তা আপনার মনেই হয় না।
অপরাধীর মত হাসল বাবর। বলল, তোমার কথা তাহলে বল।
চুপ করে রইল জাহেদা। নিঃশব্দে গাড়ি চালাতে লাগল বাবর। কিন্তু এটাও খুব শান্তিকর বলে মনে হলো না। কথা বলার জন্যে ভারি তৃষ্ণার্ত হয়ে রইল সে। বারবার তাকাতে লাগল জাহেদার দিকে।
জাহেদা বলল, বকা খেয়ে চুপ করেছেন তো!
হুঁ। বোধহয়।
আচ্ছা বলুন, আপনার যা মনে আসে বলুন।
এভাবে কথা বলা যায় না।
কেন?
এক তরফা কথা হয় না। আমি তো শুনছি। তারপর কী হলো? রামের কী হলো?
রাম?
হ্যাঁ, এই যে বলছিলেন।
বাবর হেসে ফেলল। বলল, ঐ তো, বললামই তো। সীতাকে যে চায়, রক্ত মাংসের সীতা। সীতার স্মৃতি নয়, প্রতিকৃতি নয়; যে সীতা জীবন্ত, যে সীতা বর্তমান। আমাদের একটা দোষ কি জান? আমরা স্বাভাবিকতাকে ভয় পাই। শরীরকে ভয় পাই। ইচ্ছাকে ভয় পাই। আমরা আমাদের কামনাকে নিয়ে বিব্রত। বুকে হাত দিয়ে কটা লোক বলতে পারবে কোনো সুন্দরী মেয়ে দেখে তার ইচ্ছে হয়নি? যদি কেউ বলে যে তার হয়নি, আমি বলব, হয় সে অসুস্থ নয়তো মিথ্যুক।
ব্যতিক্রম তো আছে।
আছে। কিন্তু ব্যতিক্রম নিয়মের অস্তিত্বই প্রমাণ করে জাহেদা। বিশ্বাস কর, কাউকে দেখে আমার তাকে পেতে ইচ্ছে করবে, তার অন্তৰ্গত হতে ইচ্ছে করবে–এর চেয়ে স্বাভাবিক এবং সাধারণ আর কোনো ইচ্ছে আমি জানি না।
জাহেদা নির্বিকার মুখে চোখ দ্রুত ধাবমান দৃশ্যের দিকে রেখে শুনে যেতে লাগল, যেন ক্লাশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণসমূহ সে অধ্যাপকের কাছ থেকে শুনছে।
বাবর বলে চলল, কিন্তু ঐ যে বললাম, আমরা আমাদের দেহকে ভয় পাই, যেমন সাপকে, তুমি তো সাপের উল্লেখে শিউরে ওঠ, যেমন ভয় পাই অ্যাটম বোমাকে। কিন্তু ভয় পেলেই তো কিছু মিথ্যে হয়ে যায় না। কী বল?
বোধহয়।
বাবর সুদূরের দিকে তাকিয়ে হাসল।
হাসছেন যে?
একটা কথা মনে পড়ে গেল। আমার বড় চাচা। ইয়া ছফুট দুইঞ্চি লম্বা, টকটকে গায়ের রং, গালে সুন্নতি দাড়ি, সৰ্বক্ষণ মাথায় টুপি, কী প্রশান্ত পবিত্র দর্শন তাঁর। দেখলে ভক্তিতে মাথা নুয়ে আসত। এখনো ছবিগুলো স্পষ্ট চোখের ওপর ভাসে। এই তো সেদিনের কথা। কত দিন হবে? মাত্র তিরিশ বছর আগে। তুমি তখন কোথায়?
জাহেদা হাসল নিঃশব্দে।
তুমি তখন হওনি। আমার সেই চাচার কথা মনে পড়ল হঠাৎ।
কেন?
না, থাক। বলব না। বললে মন খারাপ হয়ে যাবে।
আপনাকে বোধহয় খুব ভালবাসতেন?
হ্যাঁ, খুব। বলতে গেলে আমি তার কাছেই মানুষ।
মারা গেছেন?
হ্যাঁ। আমি তখন ঢাকায় এসেছি। চিঠিতে জানলাম।
জাহেদা বলল, আপনিই তো বলেন মৃত্যু সবচেয়ে স্বাভাবিক, তাহলে মন খারাপ করছেন কেন?
না, সেজন্যে নয়।
বাবর চকিতে উপলব্ধি করল জাহেদা ভুল ধারণা করেছে।
তাহলে?
তুমি ভেবেছ, আমার মন খারাপ হবে? না, আমি তোমার কথা বলছিলাম। শুনলে তোমার খারাপ লাগবে। কারণ, সংস্কার তোমার রক্তের মধ্যে আছে। ভাল মন্দের চলিত ধারণায় তুমি মানুষ হয়েছ।
জাহেদা তার গায়ে টোকা দিয়ে বলল, বাহাদুরি না করে বলুন। আমি শুনব। আমার মন খারাপ হবে না।
শুনবে? শোন তাহলে। আমি তখন চাচার বাড়িতেই থাকি। পাশাশাশি বাড়ি আমাদের। চাচি তার ছেলেমেয়ে নিয়ে গেছেন বাপের বাড়িতে। তখন নামাজ পড়তাম। চাচার সঙ্গে। একদিন আছরের সময় ওজু করে চাচার কাছে গেলাম, চাচা বললেন, তিনি নামাজ পড়ে নিয়েছেন। একটু অবাক লাগল। কোনোদিন তো চাচা আমাকে ফেলে নামাজ পড়েন না।? ভাবলাম, কী জানি, হয়ত আমারই দেরি হয়ে গেছে। নামাজে দাঁড়িয়েছি, ঠিক তখন, মনে হলো উঠানে নিচু গলায় চাচা কী যেন কাকে বলছেন। এ রকম কণ্ঠ চাচার কখনো শুনিনি। আমার সেই বয়সেই বুদ্ধি হয়েছিল খুব, আমি বুঝতে পেরেছিলাম। গলা শুনেই যে গোপন কিছু একটা চলছে যা আমার শোনা উচিত নয়।
থামালেন কেন? তারপর?
আড়চোখে তাকিয়ে দেখি, উঠানে চাচা আব্বাসের মাকে কী যেন বলছেন। আব্বাসের মা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, সারা গা যেন থর থর করে কাঁপছে তার।