জাহেদা তখন থেকে কী একটা সুর গুন গুন করছিল।
কী গাইছ? মিষ্টি করে হাসল জাহেদা। অনেকটা কাল রাতে দেখা সুষমার মত।
বাবর বলল, গাইতে পার জানতাম না তো।
কতটুকুই বা জানেন?
মানে?
আমার কতটুকই বা আপনি জানেন!
তা সত্যি। বাবার হাসল। পরে যোগ করল, আমার সব জান?
হুঁ, জানি।
কী জান?
বলব না। বলে জাহেদা হঠাৎ বাবরের হাত চকিতে ছুঁয়ে দিল। আপনাকে জানি না? আপনাকে চিনতে বাকি নেই আমার। বুঝছেন?
বাবর বাঁ হাত জাহেদার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছিল। সে আলতো করে সরিয়ে দিয়ে বলল, গাড়ি চালান।
বলে আবার সে গুন গুন করতে লাগল। তখন বাবরও গুন গুন করে উঠল। ইচ্ছে করে নয়, জাহেদার সঙ্গে পল্লা দিতে নয়, একেবারে ভেতর থেকে।
জাহেদা হেসে বলল, কী গাইছেন?
একটা গান।
সে তো বুঝতেই পারছি। জোরে গাইলে শুনতে পেতাম।
বাবর গান থামিয়ে বলল, এই গানটা মাঝে মাঝে আমার মনে পড়ে। গানটা কিছু নয়, ছেলেদের একটা কবিতা। বাংলা পড়লে ছেলেবেলার বইতে পেতে। বাংলাদেশের এমন কোনো ছেলেমেয়ে নেই জানে না।
শুনিই না।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি। এইভাবে শুরু–মেঘের কোলে রোদ হোসেছে বাদল গেছে টুটি, আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি। ছেলেবেলায় খুব ভাল বুঝতে পারতাম এটা। সারাদিন সারারাত সারাদিন অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে, তারপর হঠাৎ করে মেঘ দরোজা খুলে দিল, রোদ পা বাড়ােল পৃথিবীর মস্ত আঙিনায়। তখন কী যে খুশি হতো। কে যেন ডাক দিত কোথা থেকে। মাতামাতি করে বেরুতাম ঘর ছেড়ে, একেবারে পাখির মত মনে হতো। এখনো যখন কিছু হয়ে যায়, কিছু পেয়ে যাই যার জন্যে গুমোট অপেক্ষা করেছিলাম, তখন ঐ পাখির মত লাগে। গানটা মনে পড়ে। রবি ঠাকুরের লেখা।
টেগোর?
বাবর হেসে সস্নেহে বলার, হ্যাঁ, টেগোর।
শুনুন। জাহেদা পাশ ফিরল, আদুরে গলায় বলল, ভাল কথা মনে পড়েছে। টেগোরের শ্যামা বলে একটা লং প্লেয়িং রেকর্ড আছে না?–আমাকে যোগাড় করে দিতে পারেন?
কেন? কী হবে?
বারে, বাজাব, শুনব। কত নাম শুনেছি রেকর্ডটার। দেবেন?
আচ্ছা। নিশ্চয়ই দেব। তোমার প্লেয়ার নেই?
শরমিনের একটা ছোট্ট আছে।
তোমাকে একটা প্লেয়ারও কিনে দেব।
না বাবা না।
কেন? বাড়িতে কৈফিয়ৎ দিতে হবে না? তখন কী বলব?
বলবে, মাসে মাসে টাকা জমিয়ে কিনেছ। সারপ্রাইজ দেবার জন্য এতদিন বলনি।
জাহেদা চোখ পাকিয়ে বলল, আপনার মাথায় যত নষ্ট বুদ্ধি জোটে। বলেই হেসে ফেলল।
বাবর বলল, হ্যাঁ স্বীকার করি, এবার করলাম তুমি আমাকে জান।
জানিই তো। কী ভেবেছেন সাহেব?
বলে সীটে গা এলিয়ে জাহেদা আবার গুন গুন করতে লাগল।
সৈয়দপুর পার হয়ে গেল ওরা।
জাহেদা নীরবে চোখ মেলে তাকিয়েছিল সমুখে। তার শরীরের চমৎকার একটা সুবাস থেকে থেকে নাকে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল; জাহেদাকে আরো কাম্য বলে মনে হচ্ছিল তখন। স্মিত মুখে বাবর বাসনার সেই আসা-যাওয়া উপভোগ করছিল তার সারা শরীর দিয়ে।
হঠাৎ জাহেদা প্ৰায় আচমকা একটা প্রশ্ন করল।
যদি কিছু হয়?
বাবর চমকে উঠল যেন।
কী কিছু হয়?
যদি কিছু হয়?
সাবধানে সামান্য একটু হাসল বাবর প্রথমে। তারপর বাঁ হাতে জহেদার কাঁধ জডিয়ে নিল। দুষ্টুমি গলায় বলল, কিছু হয়ত হবে।
জাহেদা বোবা চোখে বড় করে তাকাল বাবরের দিকে।
হ্যাঁ, কিছু হয়ত হবে। তার জন্যে এত ভাবনা কীসের? আমার ছোট বোন থাকে আজাদ কাশ্মীরে। ওর স্বামী আর্মির ডাক্তার বলেছি তোমাকে?
জাহেদা মাথা নাড়ল।
বলিনি? তার ওখানে তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাব। তোমার বাবা জানবে কোনো ছাত্রীদলের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে বেড়াতে গেছ। সেখানে আমার বোনের কাছে বাচ্চা হবে। তুমি চলে আসবে। বাচ্চা থাকবে ওর কাছে। একটু বড় হলে নিয়ে আসব। আমার মেয়ে পছন্দ। তোমার?
জাহেদা শুনছিল আর ক্রমশ মাথা নিচু করছিল। এবার চোখ তুলে বলল, না, না, সত্যি কিছু হয়ে গেলে?
আদর করে হঠাৎ জাহেদাকে একটু কাছে টেনে নিল বাবর, তারপর ছেড়ে দিয়ে বলল, ঠাট্টা করছিলাম। কিছু হবে কেন? আমি জানি কী করে কী করতে হয়।
জাহেদা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরোজার সাথে ঠেস দিয়ে বসল।
কাল তুমি কাদছিলে কেন?
অনেকক্ষণ পর জাহেদা বলল, আচ্ছা, এইসব ছাড়া আমরা ভালবাসতে পারি না? বলেই সে হাসিতে সপ্ৰতিভ হবার চেষ্টা করল। খুব ছেলেমানুষ দেখাল তাকে এখন।
বাবর এক মুহূর্ত ভােবল। ভালবাসা সম্পর্কে তার ধারণা পরশু রংপুরে আসতে আসতে জাহেদাকে সে বলেছিল। ভুলে গেল কী করে এরই মধ্যে মেয়েটা? এখন আবার বলবে? না, থাক। কাল আর পরশু রাতের পর এখন ওভাবে বললে অন্যরকম মনে করবে জাহেদা।
কথা আজ পর্যন্ত তাকে প্রতারণা করেনি। এখনো করল না। বাবর বলল, সেদিন রাতে মন্দিরে গান শুনেছিলে মনে আছে?
এটা কী উত্তর হলো বুঝতে না পেরে হকচকয়ে জাহেদা বলল, হ্যাঁ।
গানে বলছিল না?–চাই না। স্বর্ণসীতা চাই না?
হ্যাঁ।
স্বৰ্ণসীতা বুঝেছ?
জাহেদা মাথা নাড়ল।
না বোঝবারই কথা। আমরা যে কালে বড় হয়েছি রামায়ণ মহাভারত তখন এমনিতেই জানা হয়ে যেত। রামায়ণে আছে, সীতাকে রাবণ চুরি করে নিয়ে গেল। যুদ্ধ করে তাকে উদ্ধার করে আনল রাম। অযোধ্যায় রাজা হলো রাম আর সীতা তার রাণী। প্ৰজারা বলাবলি করতে লাগল, সীতা এতদিন বাবণের কাছে বন্দি ছিল, সীতা কি সতী আছে? প্ৰজাদের মনোরঞ্জনের জন্য রাম তখন সীতাকে নির্বাসন দিলেন।
কী নিষ্ঠুরতা! জাহেদা চোখ গোল করে মন্তব্য করল।