জাহেদা তখন ভীরু কণ্ঠে জিগ্যেস করল, জেগে আছেন?
বাবর তখন শুনল কিন্তু উত্তর দেয়া হলো না। অনেক সময় নীরব থেকেই মনে হয় বলা হয়ে গেছে।
কই, আপনি জেগে?
হ্যাঁ।
আপনার কথা শুনছি না?
কথা শুনতে চাও?
হ্যাঁ।
যা খুশি।
বাবর সমুখে তাকিয়ে অন্ধকারে মৃদু হেসে বলল, এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার ইস ইকুয়াল টু এ স্কোয়ার প্রাস বি স্কোয়ার প্লাস টু এ বি। এ মাইনাস বি—
ও-কী? জাহেদা এই প্ৰথম মুখ ফিরিয়ে বাবরকে দেখল। বলল, ও-কী বলছেন?
অ্যালজেব্রার একটা ফর্মুলা।
এই বুঝি কথা?
তাহলে কী বলব?
জানি না। জাহেদা মুখ ফিরিয়ে নিল, তাকাল আবার সেই শূন্যের দিকে।
বলি? হেডা, ও হেডা, তোমাকে ভালবাসি।
না, আমি শুনতে চাই না।
আসলে তুমি আমার কথা শুনতে চাও না জাহেদা। বলতে বলতে বাবর উঠে দাঁড়াল। আসলে আমি এখন কথা বলতে চাই না। বাবর এসে জাহেদার পাশে শুলো। আসলে তুমি এখন আমাকে চাও। বাবার কম্বলের ভেতর ঢুকে জাহেদাকে কাছে টানল। আসলে তোমার এক লাগছে। আমারও হেডা, আমারও লাগছে। বলে সে প্রথমে তার কপালে একটা চুমু দিল, তারপর ঠোঁটে। বিশুষ্ক থেকে ধীরে ধীরে সিক্ত হয়ে এলো ঠোঁট। নিষ্প্রাণ যেন সপ্ৰাণ হয়ে উঠল। জাহেদাকে একেবারে বুকের মধ্যে নিয়ে সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে আলিঙ্গন করল বাবর।
তখন একবার কেঁপে উঠল মেয়েটা। তারপর হঠাৎ একটা নিঃশ্বাস ফেলে তার বাহুমূলে মুখ গুঁজে চুপ করে পড়ে রইল।
এই সময় বাবর মুঠো করে ধরল জাহেদার হাত। তারপর সেটা এনে রাখল। তার উত্তপ্ত অঙ্গের ওপর। প্ৰথমে বিদ্যুতে হাত পড়ার মত হাতটা টেনে নিল জাহেদা। কিন্তু আলাদা হতে পারল না। আস্তে আস্তে কম্পিত করতল সে এবার রাখল। ওখানে। তার আঙুলের ডগায় কেন্দ্রীভূত হলো সমস্ত জীবন। জন্মের বেদনা। ভয়, বিস্ময় একত্রিত মিশ্রিত হয়ে একটি উত্তাপের আকার ধারণ করল। সে ধীরে ধীরে মুঠো করে ধরল। তারপর দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে ছেড়ে দিয়ে আবার আঁকড়ে ধরল সে। এবার আর ছাড়ল না। জ্বলন্ত ফুলকি ছড়ান একটা তারাবাতি শিশুর মত মুঠোয় ধরে রইল জাহেদা। সে একই সঙ্গে এক এবং দুই হয়ে গেল। নিৰ্ভয়ে কৌতূহলে আক্রান্ত সে অনুভব করতে লাগল বাবর যেন অন্য কারো দেহ উন্মোচন করছে অতি সন্তৰ্পণে; যেন অন্য কারো পায়ের তলায় পড়ে থাকল পাজামা, অন্য কারো বুকে বিচ্যুৎ হলো বোতাম। প্রথমে একটু ঠাণ্ড করে উঠল। তারপর কোথা থেকে একখণ্ড তাপ এসে তার পাশে স্থির হলো।
সেইভাবে স্থির থেকে কণ্ঠ থেকে নিসৃত কিছু ধ্বনি শুনল জাহেদা। সে নিজেই বলছে, কিন্তু কেন বলছে, বুঝতে পারল না, এতটুকু অপ্রাসঙ্গিক মনে হলো না, তবু আর একটা সত্তা কৌতুক অনুভব করতে লাগল। সে বলছে, আচ্ছা মানুষ শুধু নিরামিষ খেয়ে বাঁচতে পারে?
যেন টেবিলে মুখোমুখি বসে চায়ের পেয়ালা নিয়ে গল্প করছে এমনি গলায় বাবর উত্তর করল, কেন পারে না? প্রণব বাবুকে তো দেখলে।
তাই ভাবছি। আশ্চর্য!
এতটুকু আশ্চর্য নেই। এতে। তুমি জান না জাহেদা, মানুষ নিজেকে কতটা মানিয়ে নিতে পারে। তোমার কাছে যেটা অস্বাভাবিক, আরেক জনের কাছে সেটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক। তুমি যা বিশ্বাস কর, আরেকজন তা করে না। তুমি যাতে বীচ, আরেকজনের কাছে সেটাই মৃত্যু। আমি যেভাবে বাঁচতে চাই, আরেকজন সেভাবে চায় না। তুমি যা নাও, আরেকজন তা ফেলে দেয়। সবই সত্য। কারণ সত্য মাত্রেই আপেক্ষিক, এই মৃত্যু ছাড়া। হেডা, তুমি শুনছ? তুমি ভাল, তুমি সোনা, হেডা, হেডা ও। বলতে বলতে আপন দেহে সে ঢেকে দিল জাহেদাকে।
জাহেদা অস্পষ্ট স্বরে বলল, না।
হ্যাঁ, বল হ্যাঁ। না বলে কিছু নেই পৃথিবীতে ও হেডা।
না।
তখন বাবর বলল, ফোর থ্রিজা টুয়েলভ, ফোর ফোরজা সিক্সটিন, ফোর ফাইভজা টুয়েন্টি।
হঠাৎ হেসে ফেলে জাহেদা।
আর সেই মুহূর্তে বাবর তার দেহ এবং অভিজ্ঞতার অন্তর্গত হয়ে গেল। জাহেদা টের পেল তার ভেতরে একটা ক্ৰন্দন থমকে আছে যেন। সেটা নড়ছে না, বড় হচ্ছে না, ফেটে বেরুচ্ছে না, স্তব্ধ হয়ে আছে। তারপর মুহূর্তে তার দেহ একটা তীরবেগে উর্ধ্বগামী পাখি হয়ে গেল। ধীরে ধীরে ফিরে জাহেদা বালিশে মুখ গুঁজে দিল। ভেতরে সচল হয়ে উঠল তখন কান্নাটা। চাপ দিতে লাগল। ফেটে বেরুতে লাগল। ফুলে ফুলে উঠল তার শরীর।
বাবর তখন আবার তাকে কাছে টেনে চুমো দিয়ে বলল, কাঁদছ? ও সোনা তুমি কাঁদছ? কেন কাঁদছ?
জাহেদা বলল, আমার সব কিছু পর হয়ে যাচ্ছে। দূরে সরে যাচ্ছে। সব কিছু ফেলে দিয়ে আমি কোথায় যেন যাচ্ছি। কেবলি যাচ্ছি। চলে যাচ্ছি।
তখন বাবর তাকে বুকে তুলে নিল। আবার তার হাতে দিল তারাবাতিটা। বলল, এটা নাও। নাও।
যেন শিশুর হাতে একটা খেলনা তুলে দিল বাবর।
জাহেদা ধরে রইল। ক্রমশ দৃঢ় হয়ে এলো তার পাঁচটা আঙুল। যেন ছেড়ে দিলেই অর্থই পানিতে পড়ে যাবে সে।
তারপর হঠাৎ টের পেল তার ভেতর থেকে কান্নার বিদায়। সে তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাবরের কানের কাছে মুখ রেখে শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে একবার মাত্র বলতে পারল, আমাকে ফেলে যে ও না।
বাবর তাকে সারা শরীর দিয়ে আবার ঢেকে দিল।
১৮. খেলারাম, খেলে যা
হাঃ। খেলারাম, খেলে যা।
পাশে শুয়ে আছে জাহেদা। ঘুমন্ত, পরিশ্রান্ত, অধিকৃত, শিথিল। দীর্ঘলয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তার নিঃশ্বাস। সমস্ত দেহ এখন মসৃণ, কেবল কীসের স্মৃতিতে স্তনমুখে কিছু পদ্মকাঁটা ধরে আছে। ঋজু বাঁ পায়ের ওপর ডান পা-টা ভাজ হয়ে চেপে আছে দেখাচ্ছে হেনটি মাতিসের বার্নস মিউরাল ডান্স ওয়ানের মধ্য-ফিগারের মত। চুলে ঢাকা গাল চিবুক গলার কোল। চোখের কাজল দুষ্টুমিতে কপালের পাশ কালি করে আছে। সন্তৰ্পণে দেশলাই ধরিয়ে ছবিটা দেখল বাবর। তারপর দ্বিতীয় কাঠিতে জ্বালাল সিগারেট। কম্বল দিয়ে ভাল করে ঢেকে দিল জাহেদাকে। আর সে নিজে তার নগ্ন দেহটাকে হিমেল হাওয়ার হাতে ছেড়ে দিল। এখন এই শীত বড় উপভোগ্য মনে হচ্ছে। থেকে থেকে কাপন লাগছে। কাটা দিয়ে উঠছে। সারা গা। আবার সদ্যস্মৃতিটা ফিরিয়ে আনছে উত্তাপ। সিগারেটের আলোয় থেকে থেকে একটা লাল বেলুন ফুলে উঠছে, হারিয়ে যাচ্ছে, আবার দেখা যাচ্ছে।