বাবর হাসল। অনুভব করল জাহেদা তার দিকে তাকিয়ে আছে।
কিছু বলছ না?
উঁ।
শুনছ?
হ্যাঁ শুনছি।
এই মহাম্রোতে কোথাকার কে বাবর আলী খান। বাবর হাসল। কে তুমি কোন সাত্তার চৌধুরীর মেয়ে জাহেদা। বাবর আবার হাসল। কিছু এসে যায় না। কে একজন তার নাম সেক্সপীয়ার, সে হ্যামলেট লিখল কি না লিখল, তাও কিছু নয়। এই পৃথিবীর মত কত কোটি পৃথিবী আছে, কত কোটি হ্যামলেট লেখা হয়েছে, কত বিতোভেন সোনাটা লিখছে, কত বাস্তিলের পতন হয়েছে–কতটুকু জানি! এই পৃথিবী আদিতে ছিল উত্তপ্ত একটা পিণ্ড, কোটি কোটি বছর পর একটা শীতল প্রাণহীন বস্তুপিণ্ড হয়ে তা মহাশূন্যে ঘুরতে থাকবে। তখন কোথায় তোমার বাবার আলী কোথায় জাহেদা, কোথায় সেক্সপীয়ারের হ্যামলেট আর জাপানের সামুরাই আকাশ ছোঁয়া দালান আর সমুদ্রে ভাসমান কুইন এলিজাবেথ। হাঃ। বাবর হাসল। সাঁ করে গাড়ি ঘুরিয়ে বলল, চল ফিরে যাই।
ফিরতে ফিরতে বাবর আবার হাসল।
হাঃ। জান জাহেদা, মানুষ সেই জন্যেই বোধহয় ঈশ্বরের কল্পনা করে। ঈশ্বরের ধারণা একটা সীমার আরোপ, একটা আকার প্রদানের প্রচেষ্টা মাত্র। এই অনন্তকে ধারণ করতে পারি না বলেই নামে একটা ফ্রেম দিয়ে নিয়েছি। কিন্তু যাক। আমার কষ্ট হচ্ছে।
জাহেদা আবার বাবরকে দেখল। কিন্তু ক্ষণকালের জন্যে। আবার সে দ্রুত অপসৃয়মাণ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। ডাকবাংলোয় এসে জ্যাকেট ফিরিয়ে দিল জাহেদা। সেটা ডান হাতে ঝুলিয়ে বাঁ হাতে জাহেদাকে বেষ্টন করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল বাবর। বলল, হেডা, আমরা যেখানে, সেখানে আগেও ছিলাম, এখনও আছি, পরেও থাকব।
পরিচিত কথাটা শোনে জাহেদার মুখে হাসি ফুটে উঠল। অর্থহীন একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মাথার চুল ঝাড়লো সে। তখন অতি সুন্দর দেখাল। আকাজক্ষা ঝাঁপিয়ে পড়ল বাবরের সারা দেহে! ভেতরে একটা ক্ষুদ্র সূর্য উদিত হয়ে তাপ বিকিরণ করতে লাগল। অকস্মাৎ। চকিতে চোখে ভেসে উঠল।। বিষ্ণু মূর্তির ওপর ঝুঁকে পড়া জাহেদার ছবিটা। আঙুলগুলি উদগ্ৰীব হয়ে উঠল। স্পর্শ করতে। দরোজা খুলতে কেঁপে উঠল তার হাত। দুতিনবার চেষ্টা করে তালায় চাবি পরানো গেল।
দরোজা খুলে দেখে দুদিকে বিছানা সুন্দর করে পাতা। মাঝখানে চেয়ার, তার ওপর পানির জগ, গ্লাশ। দুবিছানায় দুটো কম্বল দেখে অবাক হলো বাবর। আর একটা কখন দিয়ে গেছে চৌকিদার? তাকে তো সে দিতে বলেনি? নাকি, বিকেলে যখন সে ঘুমিয়েছিল তখন জাহেদা বলেছে! সহাস্য ঠোঁট কামড়ে ধরে একটু দাঁড়িয়ে রইল বাবর। জাহেদা বাথরুমে গেল।
তখন পাজামা পরে নিল বাবর তাড়াতাড়ি। জাহেদা ফিরে এলো পোশাক পাল্টে। নীল শাদা ডোরা কাটা চিলে পাজামা। এসে সোজা কম্বলের তলায় ঢুকে মুখ পর্যন্ত টেনে দিয়ে মরার মত পড়ে রইল। কেবল পেটের কাছটা ওঠা নামা করতে লাগল তালে তালে। বাবর তখন টিপে টিপে আয়নার সামনে ফুলদানি থেকে ফুল নিয়ে কটা পাপড়ি ছিড়ল, পাপড়িগুলো ঝুরঝুর করে ফেলে দিল জাহেদার পেটের ওপর। তালে তালে পাপড়িগুলো উঠতে লাগল, পড়তে লাগল আবার উঠল, অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখল বাবর। জাহেদা এতটুকু নড়ল না। এতটুকু কৌতূহল হলো না জানতে নিঃশব্দে বাবর কী করেছে। টুক করে বাতিটা নিভিয়ে দিল বাবর। গাঢ় অন্ধকারে ড়ুবে গেল সমস্ত অস্তিত্ব। বাবর নিজের বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল কম্বল টেনে। বলল, শুভরাত্ৰি।
কোনো জবাব দিল না জাহেদা।
বাবর একটা সিগারেট ধরাল। বাথরুম থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ার শব্দ আসছে। সিক্ত অবিরাম একটা শব্দের স্রোত। অনেকক্ষণ পর চৈতন্য হলো সিগারেটটা পুরে ছাই হয়ে গেছে, আঁচ লাগছে আঙুলে। সেটা নিভিয়ে আরেকটা ধরাতেই কাঠির আলোয় দেখল জাহেদার মুখ খোলা, বুকের ওপর হাত বিছিয়ে ছাদের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে সে। আস্তে আস্তে আলো কমে এলো, অন্ধকার বাড়তে লাগল। কাঠিটা লাল ছাই হয়ে গেল। জাহেদা তেমনি তাকিয়ে রইল শূন্যের দিকে।
জাহেদা।
উঁ।
ঘুম আসছে না?
জাহেদা কোনো জবাব দিল না। বাবর সিগারেট খেতে লাগল। নিঃশব্দে। আবার সে জিগ্যেস করল, নিজের সমুখের দিকে চোখ রেখেই, কী ভাবছ? আমাকে বলবে না?
তখন প্ৰায় ফিসফিস করে জাহেদা উত্তর করল, আমি এখন আমার মা-র কথা ভাবছি। বাবর শুধু বলল, হ্যাঁ।
নিস্তব্ধ কয়েকটি মুহূর্ত পার হয়ে গেল। জাহেদা আবার বলল, শূন্যের দিকে তেমনি তাকিয়ে থেকে, আমি এখন আমার বাবার কথা ভাবছি।
হ্যাঁ।
আরো কয়েকটি মুহূর্ত গেল। আরো কয়েকটি দীর্ঘ মুহূর্ত।
আমি এখন পাপ্পুর কথা ভাবছি।
হ্যাঁ।
একটি যুগ অতিবাহিত হয়ে গেল। জাহেদা তখন বলল, আমি এখন হোস্টেলের সবুজ মাঠটা দেখতে পাচ্ছি।
হ্যাঁ।
আমি এখন আরিচার ফেরিবোটে।
হ্যাঁ, জাহেদা, হ্যাঁ।
আমি এখন সেই ছেলেটার কথা ভাবছি।
চুপ করে রইল জাহেদা। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল বাবর জাহেদার কণ্ঠস্বরের জন্যে। কিন্তু নীরবতা শাসন করতে লাগল। এই ঘর এবং ঘরের বাইরে সম্পূর্ণ বিশ্বটাকে। তখন বাবর তাকিয়ে দেখল জাহেদা কখনো তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। তার নাক, চিবুক, গ্ৰীবার উপত্যকা অন্ধকারের মধ্যে গাঢ় অন্ধকার হয়ে ফুটে আছে।
চোখ ফিরিয়ে নিল বাবর। সেও তাকিয়ে রইল। তার সমুখে। ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়তে লাগল বাথরুমে। বালিশের নিচে হঠাৎ প্রবল হয়ে উঠল। হাত ঘড়ির টিকটিক। তার সমস্ত অস্তিত্বকে ঠুকে ঠুকে বাজিয়ে যেতে লাগল ওটা।