প্রণব বাবু বলে চললেন, জন্তু জানোয়ার এদের মধ্যে এই নিয়মটা ভাল, যার যার তার তার মত থাকে। কেউ কারো গায়ে পড়ে কিছু করতে ওরা একেবারেই নারাজ। কেবল মানুষের মধ্যেই এটি দেখবেন না। গায়ে পড়ে আপনার উপকার করবে, গায়ে পড়ে আপনার ক্ষতি করে যাবে। কোথা থেকে কে যে কোন কলটি নেড়ে দিলেন টেরটি পাবেন না মশাই। ভয় পাবেন না দিদি। সাপের দেশ রংপুর। জীবন কাটিয়ে দিলাম। কত রকম সাপ দেখলাম, এখনো তো বেঁচে আছি। শুনুন তবে।
জাকিয়ে গল্প বলতে শুরু করলেন তিনি। তাঁর তখন ছেলেবেলা, একদিন রাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখেন বাড়িশুদ্ধ মানুষ জেগে। সবাই চুপচাপ, শ্বাস-প্ৰশ্বাস একেবারে বন্ধ। শুধু ওপাশের ঐ ভাড়ার, ওখান থেকে ভীষণ ফোসফোসানি আর ঠকাস ঠকাস একটা শব্দে শোনা যাচ্ছে। খুড়ো মশাইয়ের কোলে চেপে গিয়ে দেখেন, হারিকেনের আলোয় দেখা যাচ্ছে ইয়া এক কেঁদো সাপ। এই এতবড় একটা ফণা–প্রণব বাবু দুথাবা পাশাপাশি ধরে দেখালেন। দুধের মত ধবধব করছে, মাথায় সিঁদুরের ফোঁটা। কী গর্জন তার। লকলক সকসক করছে জিভ। চোখ হীরের মত জ্বলজ্বল করছে–এই এত বড় বড় দুটো চোখ। একবার করে ছোবল মারছে একটা ছোট্ট খাট ছিল বাচ্চাদেশ, ভাঙ্গা, তার পায়ার ওপর। আবার ঘুরে যাচ্ছে। আবার গজরাচ্ছে, আবার এক ছোবল। শব্দ উঠছে ঠিকাস ঠকাস। ফোসাচ্ছে না তো যেন শালকাঠ চিরছে করাতিরা। সে-কী ভয়ানক ক্ৰোধ। রাজকীয় ক্ৰোধ মশাই! সে-কী সৌন্দর্য। সে-কী আক্ৰোশ। বাবা লোক পাঠালেন সামাদ নামে এক চরিত্রের কাছে। ইয়া দশাসই চেহারা, লাল ভাটার মত চোখ, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া বাবড়ি, দেবী চৌধুরাণী দলের ডাকাত যেন মশাই। সে খবর পেয়ে তেলপাকা কুচকুচে লাঠি নিয়ে এলো। এলো বটে। কিন্তু দূর থেকে দেখেই বলল, কর্তা, বলেন তো জান দেব, কিন্তু সাহস পাই না। সালাম করে চলে গেল সে।
যতটা সঙ্কুচিত হয়ে থাকা যায় জাহেদা তাই আছে। বারবার পায়ের কাছে দেখছে। মুখ একেবারে ছাই। বাবর বলল, সাপটা অমন করছিল। কেন?
কী জানি মশাই, তা জানি না। বোধহয় কোনো ইঁদুর টিদুর ফসকে গিয়েছিল।
আর কোনোদিন দেখেছেন? সম্মোহিত গলায় জাহেদা প্রশ্ন করল। ভয়ের একটা সম্মোহন আছে যখন আর ভয় করে না।
না। আর একবার দেখেছিলাম। বাবা মারা গেলেন। শ্মশান থেকে ফিরে এসে দাওয়ায় বসে আছি দেখি সাপটা চলে যাচ্ছে।
কোথায়?
বোধহয় বাড়ি ছেড়েই যাচ্ছিল। তারপর আর দেখিনি। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন প্রণব বাবু। সাপ না স্বর্গীয় পিতা কাকে তিনি কল্পনায় প্রত্যক্ষ করছেন বোঝা গেল না। গমগম করতে লাগল সারা ঘর। বাবর তাকিয়ে দেখল সুষমা কখন দরোজার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
স্মিতহাসি ফুটে উঠল প্রণব বাবুর মুখে।
আরেক দিনের কথা। এই তো মাত্র বছর খানেক আগে। সেদিন একেবারে ফুটফুটে পূৰ্ণিমা। রাত অনেক হয়েছে। সুষিরা ঘুমিয়ে পড়েছে। বারান্দায় চুপচাপ একা বসে আছি। রামটহল ব্যাটা সেদিন, ইয়ে, সিদ্ধি বানিয়েছিল, একগ্লাশ পান করা হয়েছে। এই যে বারান্দা, এখন রাত বলে বুঝতে পারছেন না, এর পুব কোণ থেকে বাঁশঝোপটা দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে আছি। পূর্ণিমার আলোয় খাড়াখাড়া ছায়া পড়ে ভারি সুন্দর লাগছিল। বাঁশতলা। হঠাৎ দেখি জোড়ায় জোড়ায় সাপ।
অস্ফুট আৰ্তনাদ করে উঠল জাহেদা। বাবর তার হাত ধরল ক্ষণেকের জন্যে।
বুঝলেন, জোড়ায় জোড়ায় সাপ। একজোড়া দুজোড়া নয়, অন্তত শখানেক হবে। একেবারে কিলবিল কিলবিল করছে। পূর্ণিমার আলোয় দেখাও যাচ্ছে স্পষ্ট। সব মাথা তুলে জড়াজড়ি করে নাচছে। নাচ করছে মশাই, নাচ। হেলে দুলে ডাইনে বাঁয়ে। এমনি এমনি করে।
প্রণব বাবু নিজের দুহাত জড়িয়ে ফণার মত তুলে নাচিয়ে নাচিয়ে দেখালেন।
জাহেদা বাবরের হাত শক্ত করে ধরল। বলল, চলুন।
হ্যাঁ, এইতো।
খপ করে হাত নামিয়ে নিলেন প্রণব বাবু।
যাবেন?
ওর শরীরটা ভাল নেই। তাছাড়া ছেলে মানুষ তো, ঘুম পাচ্ছে। রাত হলো। বড্ড হতাশ হলেন প্রণব বাবু। নিতান্ত অনিচ্ছাসত্বেও উঠে দাঁড়ালেন। হতাশ গলায় বললেন, আর একটু বসবেন না? চা খাবেন? চা? সুষি চা করে আনুক।
না, এত রাতে আর কষ্ট করবেন না। এমনিতেই সুষমাকে অনেক জ্বলিয়ে গেলাম।
সুষমা পথ ছেড়ে দিয়ে আবার সেই মিষ্টি হাসিটা তৈরি করল।
১৭. শীত করছে
গাড়িতে বসে গায়ে কাঁপন দিল জাহেদার। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। এতক্ষণ শিশিরে ভিজে ভেতরটা একেবারে হিমাগার হয়ে আছে।
শীত করছে?
হুঁ।
বাবর তার জ্যাকেট খুলে দিল।
এটা জড়িয়ে নাও।
না।
দাঁতে দাঁত বেজে উঠল জাহেদার। বাবর শাসন করে উঠল, শীতে মরবে তবু কথা শুনবে না মেয়ে।
জোর করে জ্যাকেটটা চাপিয়ে দিল জাহেদার গায়ে। বলল, গাড়ি চললে ভেতরটা গরম হয়ে উঠবে।
আপনার শীত করবে না?
করবে তো! তা কী করা যাবে? ঠাট্টা করে বাবর বলল। বড় রাস্তায় এসে জিগ্যেস করল। ঘরে যাবে, না একটু ঘুরে আসবে?
জাহেদা কোনো কথা বলল না।
চল, ঘুরেই আসি। কারমাইকেল কলেজের দিকে গাড়ি ছোটাল বাবর। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকবার পর বলল, থমথমে এই রকম রাতে তোমাকে আর কবে নিয়ে বেরুব, কে জানে?
কেন বলছেন?
এমনি। আমার খুব ভাল লাগছে। যা ভাল লাগে তা ধরে রাখা বোকামি। মানুষ ধরে রাখতে চায় বলেই দুঃখ পায়। আসলে সব কিছুই একটা স্রোতের মত। সুখ, ঐশ্বৰ্য, জীবন, আকাশ, বিশ্ব, মহাবিশ্ব, ছায়াপথ, তারকাপুঞ্জ, সব কিছু। সমস্ত কিছু মিলে প্রবল শুভ্ৰ জ্বলন্ত একটা মহাস্ত্ৰোত মনে হয়। দুঃসহ কষ্ট হয় তখন। আমার জীবনে যদি একটা কোনো কষ্ট থাকে তাহলে তা এই! এই মহাস্রোতের সম্মুখে আমি অসহায় তুচ্ছ। তুমি আমি এই শহর, মহানগর, সভ্যতা সব অর্থহীন বলে মনে হয়। আমি কী করলাম, তুমি কী করলে, ন্যায়অন্যায় পাপ-পুণ্য, মনে হয় সবই এক, সব ঠিক আছে–কারণ সবই কত ক্ষুদ্র।