আমাকে স্বার্থপর বললেন, না?
আপনি ভুল বুঝবেন না।
না, না ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আমার কেন যেন কিছুদিন থেকে কেবল মনে হচ্ছিল লতিফার বিয়ে দেওয়া দরকার।
হঠাৎ গলার কাছে কেমন দলা পাকিয়ে এলো বাবরের। অত্যন্ত সন্তৰ্পণে জিজ্ঞেস করল সে, কেন এ রকম মনে হচ্ছিল?
জানি না। ঠিক আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। গত ছুটিতে দিন কয়েকের জন্য বাড়িতে এসেছিল লতিফা—
বাবরের মনে পড়ল, সে তাকে গাড়িতে করে ইস্টিশনে দিয়ে গিয়েছিল। শখ করে লতিফা সেদিন একটা শাড়ি পরেছিল গাঢ় নীল রংয়ের। বাবর বলেছিল, সকাল বেলার এই চড়া রদ্দুরে গাঢ় নীলটা চোখে লাগছে, তার উত্তরে লতিফা বলেছিল, চোখে লাগাবার জন্যেই তো পরা।
দিন কয়েকের জন্যে বাড়িতে এসেছিল লতিফা। ও যখন আসে। আমি তখন অফিসে। বাসায় ফিরে দেখি মেয়েটা শুয়ে আছে। ঘুমুচ্ছে। সেই তখনই কথাটা চমক দিয়ে গেল মনে। লতিফার বিয়ে দেওয়া দরকার।
তবু স্পষ্ট বুঝতে পারল না বাবর। সে আরো কিছু শোনার প্রত্যাশায় উৎকৰ্ণ হয়ে রইল। তার মাথাতেও সুরার ক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু কাজী সাহেব অনেকক্ষণ আর কিছু বললেন না বলে বাবরই সরব হলো।
তখনই বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেললেন বুঝি?
সুস্থ অবস্থায় থাকলে এ রকম একটা হাস্যকর কথা না বক্তা বলতে পারত না শ্রোতা শুনতে পারত। গাম্ভীৰ্য না হারিয়ে। কাজী সাহেব উক্তিটা বিবেচনা করে উত্তর দিলেন, না ঠিক তখনই ব্যবস্থা করা যায় নি। তবে ওর মাকে সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলাম।
ভাবী কী বললেন?
তিনি বললেন মেয়ের বয়স কম। আমি বললাম, রাখি বয়স। আগের দিনে সতের বছরে চার ছেলের মা হতো। আমার মা পনের বছরে আমাকে পেয়েছিলেন। আপনার মা?
সুরাপানে বাবর অভ্যস্ত। তাই সে অবিরাম এতক্ষণ পান করার পরও কোনোক্রমে বুঝতে পারল কাজী সাহেবের বেশ নেশা হয়েছে। শেষ প্রশ্নটা তার প্রমাণ।
আপনার মায়ের কত বছরে আপনি হয়েছিলেন বলুন তো? কাজী সাহেব এবারে বিশদভাবে প্রশ্নটা করলেন।
আমার মনে নেই।
হাঃ হাঃ হাঃ। আপনার মনে থাকবে কী করে? আরে, আপনার তো তখন জন্মই হয়নি। হাঃ হাঃ হাঃ!
বাবর হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল, বলল নয়, বলে টের পেল সে বলে ফেলেছে, লতিফাকে আমি পছন্দ করি।
লতিফাও বলে বাবর চাচা আমাকে খুব স্নেহ করে।
বলেছে আপনাকে?
কতবার বলেছে। বিশ্বাস না হলে বাসায় ফিরে আপনার সামনেই জিজ্ঞেস করব। নিজ কানে শুনে যাবেন।
আপনার মেয়ের মত মেয়ে আমার চোখে পড়েনি, জানলেন কাজী ভাই।
দোয়া করবেন।
তা সব সময়েই করি।
বাপের মনতো, বেশি প্রশংসা শুনলে মনটা ভয় পেয়ে যায়।
না, না কী যে বলেন ও সব কুসংস্কার।
আপনি আরো নিন। বেয়ারা!
আপনি?
ব্যাস, আমি আর না।
সে হয় না।
আচ্ছা বলছেন যখন, আরেক পেগ নিচ্ছি। বেয়ারা, সাবকে দুটো দাও। দাও, দাও এক সঙ্গে ঢেলে দাও।
স্যার, দশটা বাজে, এখন বন্ধ করতে হয়।
চুপ হারামজাদা।
স্যার, সেক্রেটারী সাহেবের অর্ডার।
ফের কথা।
বেয়ারা চুপ করল।
বাবর বলল, চলুন, গ্লাশটা শেষ করেই উঠা যাক। ভাবী ওদিকে রান্না করে বসে আছে।
আরে আপনি আছেন বলে আমি নিশ্চিন্তে আছি। যত রাতই করি না কেন, কিছু বলতে পারবে না। হাঃ হাঃ। তবে ঐ মেয়েটাকে নিয়ে ভয়।
লতিফা?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঐ একটাই তো আমার মেয়ে। ওর মা বুঝলেন কোনোদিন আমাকে শাসন করে জুৎ করতে পারেনি, আর সেদিনের মেয়ে, আমারই পেটে হলো, আরে কী বলছি, আমারই ইয়েতে, মানে আমারই মেয়ে, বুঝতেই পারছেন কী বলছি–
হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।
সেই মেয়ে আমাকে এমন শাসন করে–হাঃ হাঃ। আপনার মেয়ে আছে তো, বুঝবেন, নিজেই বুঝতে পারবেন, মাশআল্লা বড় হোক। কী যেন নাম আপনার মেয়ের?
তাইতো কী যেন একটা বানিয়ে বলেছিল বাবর ভারি মুশকিল হলো তো! কিন্তু বানিয়ে কথা বলা আর কথা বিক্রি করে খাওয়া বাবরের পেশা। সে পাল্টা বলল, লতিফার বিয়ে তাহলে আপনিই ঠিক করলেন। কী করে কথাটা পারলেন ওর কাছে?
আরে বাবার সাহেব, সেই কথাই তো বলছি। মেয়ে আমার বাড়িতে এসেই মাকে বলে, বিয়ে টিয়ে দেবে না আমাকে? শুনুন কথা।
লতিফা নিজে বলেছে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনে দেখবেন আপনার ভাবীর কাছে।
অবাক হয়ে গেল বাবর। লতিফা নিজে বলেছে, যেন বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। তার মুখ দিয়ে একটা শব্দ গড়িয়ে পড়ল।
আশ্চর্য।
জানি, জানি, আপনি অবাক হবেন। কিন্তু মেয়েকে আমি সে শিক্ষা দিইনি যে, মনের কথা মনে পুষে রাখবে। আমরা বাবা মা চিরদিন ওকে বুঝিয়েছি যে আমরা তোর বন্ধু, সবচে ভাল বন্ধু। তাই যে কথাটা আর দশটা মেয়ে বলতে লজ্জায় হার্টফেল করত, সে কথা আমার মেয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই বলতে পেরেছে।
তারপর?
তারপর আর কী? বিয়ে দেবার কথা আমিও ভাবছিলাম। ঐ যে বললাম, তাছাড়া আপনি বললেন, আমি স্বার্থপর। মেয়েকে পর করে নিশ্চিন্ত হতে যাচ্ছি। সেটাও আছে। লিখে দিলাম কামালের মাকে চিঠি। আপনাকে দাওয়াত করব। আসতেই হবে। আপনি না এলে লতিফার বিয়েই হবে না।
আসব, আসব।
আসব বললে হবে না, আসতেই হবে।
আসব। কেন আসব না? এই যে না বলে না কয়ে হঠাৎ চলে এলাম।
সত্যি কী যে খুশি হয়েছি।
এক চুমুকে গ্লাশ শেষ করল বাবর। কিছুতেই এ বিস্ময় তার যাচ্ছিল না যে লতিফা নিজে বিয়ে করতে চেয়েছে। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে লতিফার মুখ। লম্বা ডিমের মত। লাল লাল ফর্সা। একটা নীল শিরা, কোথায় যেন সুন্দর একটা কাঁথায় নীল সুতার মত। লতিফাকে একবার চোখে দেখতে ভারি ইচ্ছে করছে বাবরের।