ভেতরের আঙিনায় গিয়ে পড়ল ওরা। বিশাল উঠান। চারদিকে চাকমিলানো ঘর। সব ঘরের দরোজা বন্ধ। অন্ধকার। ভূতুড়ে বাড়ির মত মনে হয়। মনে হয় যারা ছিল তাদের কথাবার্তা নিঃশ্বাস এখনো গমগম করছে।
প্ৰদীপ হাতে এক তরুণী কোথা থেকে বেরিয়ে এসে বলল, নমস্কার।
এটা হচ্ছে সুষমা।
চৌকো শ্যামল মুখ। চোখে ঘুম জড়ান। মিষ্টি হেসে বলল, আসুন।
সব তৈরি তো সুষি? প্রণব বাবু জিগ্যেস করলেন।
কখন সব করে রেখেছি। কাকা, তুমি ওঁদের বসতে দাও। আমি এক্ষুণি আসছি।
চলে যেতে যেতে সুষমা জাহেদার দিকে তাকিয়ে আবার হাসলেন। নির্মল কিন্তু করুণ একখণ্ড হাসি। চোখে লেগে রইল বাবরের।
প্রণব বাবু বললেন, আমার এক আশ্রিত পরিবার, তাদের মেয়ে। আমার কেউ না। আমার দেখাশোনাটা হয়ে যায়, বাড়িটাও খালি থাকে না। এই আর কী।
ভেতরে গিয়ে বসল। ওরা। একদিকে বিরাট একটা খাট–ব্যাডমিন্টন খেলার মাঠের মত। এতবড় বিছানা এর আগে কখনো বাবর দেখেনি। জাহেদা বলে উঠল, মাই গুডনেস।
আগাগোড়া নিভাঁজ চাদর। একজোড়া বালিশ। তিনটে কোলবালিশ মুখখোলা নিখুঁত একটি আয়তক্ষেত্র সৃষ্টি করে আছে মাঝখানে। বিশাল মশারির মুখটা থিয়েটারের পর্দার মত দুদিক থেকে তোলা। ঘরের আরেক দিকে প্রণব বাবু লেখাপড়া করেন। সুন্দর করে সাজান টেবিল। পুরনো কাচের আলমারি। ভারি ভারি কাসার তৈজসপত্র। দেয়ালে বাধান স্বামী বিবেকানন্দ। আরেক দিকে জিন্নাহ সাহেবের ঐঙ্গিন একটা ছবি! একটা পুরনো ঢাল ঝুলছে। খোলা জানালায় স্তিমিত হয়ে আছে অন্ধকার। দুটো গোল পাথরের টেলিল ঘরের মাঝখানে এনে খাড়া পিঠ চেয়ার টেনে প্রণব বাবু বললেন, আসন নিন।
বাবর জিগ্যেস করল, আপনার পিতৃপুরুষের কারো ছবি দেখছি না।
ছিল। সব ছেলেমেয়েরা নিয়ে গেছে। আমার হয়েছে মশাই সেই অবস্থা–কৃত্যয়োর্ভিন্ন দেশাত্বাব্দ দ্বৈধীভবাতি মসে মনঃ, পুরঃ প্রস্হিতং শৈলে স্রোতঃ শ্রোতোবাহো যথা। অর্থাৎ কিনা, পর্বতে নদী বাধা পেলে যেমন দুভাগ হয়ে যায়, আমার মনের অবস্থাও তাই। ছেলেমেয়েরা ইন্ডিয়া চলে গেল, আমি পারলাম না। বুঝে দেখুন মশাই। এটা আমার দেশ নয়? আমার মাটি নয়? এক কথায় চলে যাব? বলি, মাটি কখনো পর হয়ে যায়? শুনে দেখবেন মশাই যারা গেছে তারা ঐ রাত্তিরে দেশের দিকে মুখ করে কাঁদে।
এর মধ্যে নিঃশব্দে সুষমা খাবার সাজিয়ে দিয়েছে। এখন সেই মিষ্টি হাসিটা ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এককোণে।
গরম ধোঁয়া ওড়ানো ভাত। তার ওপর গলে পড়ছে সোনার মত ঘি। চারদিকে ছোট ছোট দশ বারোটা করে বাটি। সব নিরামিষ। কোনোটায় ঝাল, কোনোটায় ভাজা, টক, মিষ্টি তেতো, দুরকম ডাল, বেগুনি, চচ্চড়ি, মাংসের মত করে রাধা ছানার বিরফি, অম্বল, কিসমিস উঁকি দিচ্ছে কোনোটা থেকে।
সুষমা বলল, কাকাবাবু শুধু বকবক করেন। আপনারা খান তো।
একটি বাটি নিতে যাচ্ছিল, সুষমা বলল, না, ওটা নয়। এটা নিন। আগে ঐটে খেতে হয়। একের পর এক বলে যেতে থাকল সুষমা, কোন বাটিতে কী, কোনটার পর কোনটা খেতে হয়। প্রণব বাবু বললেন, নিজের বাড়ি মনে করে খাবেন দিদি। কী ছাইপোশ রেঁধেছে কে জানে? সুষি পড়াশোনায় যেমন লাড্ডু তেমনি রাঁধাবাড়ায়। বুঝলেন? দোষ নেবেন না।
না, না, চমৎকার হয়েছে। এত সুন্দর রানা বহুকাল খাইনি।
বাবারের সঙ্গে জাহেদাও যোগ করল, খুব ভাল।
কিন্তু কৌতুকের সঙ্গে বাবর লক্ষ করল, জাহেদা খাচ্ছে কত। শুধু নিরামিষ দেখে হকচকিয়ে গেছে বেচারা। প্রণব বাবুকে জিগ্যেস করল জাহেদা, মাছ মাংস ডিম কিছু খান না আপনি?
আমি তো খাইই না, আমার সাতপুরুষে কেউ কখনও খায়নি।
পারেন না খেয়ে?
হ্যাঁ, পারব না কেন? কোনো অসুবিধে হয় না তো!
মাছ মাংস যারা খায় তাদের অপছন্দ করেন?
হা হা করে হেসে উঠলেন প্রণব বাবু।
কেন, এই যে সুষি, সুষমা! ওরা মাছ মাংস হরদম খাচ্ছে।
বাবর জিগ্যেস করল, সুষমাকে এই প্রথম সে কথা বলল, তুমি পড়?
হ্যাঁ।
কী পড়?
এবার বি.এ পড়ছি। ফাস্ট ইয়ার।
বাহ, চমৎকার।
ও-কী, হয়ে পেল?
হ্যাঁ, অনেক খেয়েছি।
না, না, ঐ কটা ভাত রাখলেন যে। জাহেদাকে বলল, আপনি তো কিছুই খেলেন না।
জাহেদা হাসল।
সুষমা দুগ্নাশ গরম দুধ নিয়ে এলো। বাবর বলল, এ-কী!
কিছু না। দেখতেই তো পাচ্ছেন। খেয়ে নিন।
দুধ খাবার তো অভোস নেই। বাবর বলল, জাহেদা?
জাহেদা মাথা নাড়াল।
নিঃশব্দে সুষমা একে একে সব বাটি থালার ওপর সাজিয়ে চলে গেল। ফিরে এলো রূপার তশতরিতে সুন্দর করে কাটা সুপুরি আর লং এলাচ নিয়ে। বলল, বারান্দায় হাত ধোয়ার জল আছে।
বারান্দায় এসে গায়ে কাঁপুনি তুলে জাহেদা বলল, যা অন্ধকার। নিচু গলায় বাবর জিগ্যেস করল, খেয়েছ ঠিক মত? কেমন লাগল?
এক রকম। — দেখেছেন মেয়েটা কেমন অন্ধকার দিয়ে যাচ্ছে, আসছে, একটু ভয় নেই।
কীসের ভয়?
সাপ-টাপ। বলেই শিউরে উঠল জাহেদা। কোনো রকমে হাত মুছে ঘরে ছুটে গেল।
বাবর ভেতরে এসে বলল, জানেন প্রণব বাবু, আজ সকালে মহারাজ দর্শন হয়েছে।
মহারাজ মানে?
প্রায় পাঁচ হাত লম্বা এক গোখরো।
সঙ্গে সঙ্গে কাঁন্দ কাঁদ হয়ে গেল জাহেদা। বলল, প্লীজ।
হা হা করে হেসে উঠে কোলে বালিশ টেনে প্রণব বাবু বললেন, দিদির বোধহয় খুব ভয়? তাহলে শুনুন বলি, আপনি ওকে যতটা ভয় পান, ও-ও আপনাকে ঠিক ততটাই ভয় পায়। আপনি কিছু না করলে ও আপনাকে কিছুই করবে না।
অবিশ্বাস আর ভয় ভরা চোখে তাকিয়ে রইল জাহেদা।