লজ্জায় মাথা নিচু করল জাহেদা।
বাবর তখন বলল, বাংলা ভাল বোঝা না বোঝা শোনার ভাণ করে যাও।
এবারে শোনা গেল, বক্তা বলছেন, এই কথাগুলো আমাদের প্রিয় বাবর সাহেবকে বললাম, তিনি যেন ঢাকায় গিয়ে সমস্ত শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীকে জানিয়ে দেন।
আমার আর কিছু বলার নাই। প্রণব বাবু বললেন, আমরা স্থানীয় তরুণ কবি, আমাদের পরম স্নেহভাজন আকসাদ মোল্লার কথা শুনলাম। এবার বাবর সাহেব আপনি কিছু বলুন।
বাবর সলজ্জ হেসে বলল, বলতেই হবে?
কিছু না বললে, এরা সবাই এসেছেন, বলুন কিছু।
বাবর উঠে দাঁড়াল। সবার দিকে দেখে মুখ নিচু করল একবার। সত্যি বলার কিছু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক মুহূর্ত পর তার চিরকালের যে অভ্যোস ঝুঁকির মধ্যে বাস করা, সেই অভ্যেসের বশে কিছু না ভেবেই শুরু করল এবং বলতে বলতে নিজেই আরেকবার চমৎকৃত হলো নিজের গুণে, চমৎকৃত হলো কথার পিঠে কথা কী স্বচ্ছন্দভাবে এসে যাচ্ছে বলে।
সে বলতে লাগল, বন্ধুগণ! প্রণব বাবু আসলে একটি পরকলা। ছোট জিনিস বড় দেখায় তার কল্যাণে। নইলে আমার মত মানুষকে যে সমস্ত বিশেষণে তিনি সম্মানিত করেছেন, তার একটিও শাদা চোখে দেখা যেত না। মানুষকে, কোনো মানুষকে এই যে আপন করে নেবার অসাধারণ ক্ষমতা, তার এবং আপনাদের সবার, এর একটা বিশেষ মূল্য আছে। এটা প্ৰাণের পরিচয় বহন করে। নির্মল প্ৰাণ, স্বচ্ছন্দ প্ৰাণ, সংবেদী প্ৰাণ। আমি বলি, সবার ওপরে এই প্ৰাণের স্থান। এই প্ৰাণের অনুমতি নিয়ে, এই প্ৰাণের অন্তর্নিহিত শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে, এই প্ৰাণের প্রেরণায়, যারা যা কিছু করেন তাই সত্য, তাই সুন্দর, তাই কল্যাণ। মনের ভাষা আমরা সবাই শুনতে পারি না। আপনাবা শুনছেন। তাই আপনারা আমার চিরকালের প্রিয় হয়ে রইলেন। আজকের এই সন্ধ্যার স্মৃতি আমি আমৃত্যু বহন করব। এবং হ্যাঁ আপনাদের ক্ষোভ, আপনাদের এই প্রতিরোধের সংবাদ আমি ঢাকার শিল্পী সাহিত্যিকদের কাছে পৌঁছে দিব। আপনাদের রংপুরের ছেলে সৈয়দ শামসুল হক, টেলিভিশনে প্রায়ই আসেন, আমি তাকে বিশেষ করে বলব। ধন্যবাদ।
একজন তরুণ উঠে দাঁড়াল। বলল, তাঁকে বলবেন সিনেমার জন্যে লিখে, টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করে যেন নিজেকে নষ্ট না করেন। আমাদের দাবি আছে তাঁর ওপরে।
বাবল বলল, আমি যতদূর জানি, সেটা তার জীবিকা। তিনি তো লিখছেন। অধ্যাপনা, সাংবাদিকতা এসব করেও তো লোকে লেখে।
আরেকজন উঠে দাঁড়াল। হাত নেড়ে বলল সে, হক সাহেবকে বলবেন তিনি যেন ব্যক্তির কথা না লিখে সমাজের কথা লেখেন! আমরা বেঁচে থাকতে চাই, আমরা সংগ্ৰাম করছি সে নিয়ে তাকে উপন্যাস লিখতে বলবেন।
আচ্ছা বলব।
আরো একজন উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, তাকে বলবেন গোর্কির মার মত উপন্যাস কেন হচ্ছে না? নাজিম হিকমতের মত কবিতা কেন বেরুচ্ছে না? আমরা জানতে চাই।
নিশ্চয় বলব। আমি জানতাম না। তিনি জীবনের কথা লেখেন না।
তাঁকে লিখতে বলবেন।
সভা শান্ত হলো। চা এলো, সন্দেশ এলো। সভা শেষে হাঁটতে হাঁটতে সবাই বাবর জাহেদার সঙ্গে ডাকবাংলো পর্যন্ত এলো। তারপর বিদায় নিল একে একে। সবাই অনুরোধ করল আরো একদিন থেকে যাবার জন্য। না, কালই বেরুবে বাবর। অনেকেই বাসায় ডাকলেন, অনুগ্রহ করে চাট্টি খাবেন। অনেক ধন্যবাদ, প্রণব বাবুর বাড়ি আপনাদের সবারই বাড়ি, সেখানে আতিথ্য স্বীকার করেছি, মনে করব আপনাদের সবার প্রতিনিধি তিনি।
প্রণব বাবু বললেন, চলুন তবে, রাত হয়ে গেল।
করজোড়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি।
বাবর জাহেদাকে বলল, চল, খেয়ে আসি।
গাড়ি করে বেরুল ওরা। শীতের মফঃস্বল। হিম হিম হাওয়া বইছে। ঘুমিয়ে পড়ার আয়োজন করছে। সারা শহর। এখানে ওখানে বাতি জ্বলছে, গান হচ্ছে কোথাও লাউড স্পীকারে, চাদর মুড়ি দিয়ে রিকশা চালাচ্ছে রিকশাওয়ালা। বড় রাস্তা থেকে বাঁয়ে কেটে একেবারে অন্ধকারের মধ্যে গিয়ে পড়ল ওরা। পেছনে প্রণব বাবু। সামনে জাহেদা। বাবর জাহেদার আঙুল স্পর্শ করল একবার। বরফের মত ঠাণ্ডা।
এইবার ডানে, ডানে যান মশাই। এই ডাইনে।
অন্ধকার গলিটাতে আস্তে আস্তে গাড়ি চালাতে লাগল বাবর। জাহেদা বলল, এত চুপচাপ আর অন্ধকার কেন?
পেছন থেকে হাসলেন প্রণব বাবু।
দিদি, এ যে মফঃস্বল। এই যে এলাকাটা দেখছেন পঞ্চাশ বছর আগেও এখানে বাঘ টাঘ দেখা যেত। বাবর সাহেব, যদি একটু কষ্ট করেন, এই সামনেই, দেবী সিংহের দরবার যেখানে ছিল দেখিয়ে আনি?
এই রাতে? থাক।
এখন অবশ্য নেই কিছু। শুধু ফাঁকা মাঠ। তবু দেখতেন। একবার কী হলো জানেন, কলকাতা থেকে তিন ইংরেজ কাপ্তান পাঠানো হয়েছে দেবী সিংকে গ্রেফতার করতে। দেবী সিংহ খবর পেয়ে এক হাজার সেপাই নিয়ে দরবার জাঁকিয়ে হুঁকোর নল হাতে করে গদিতে গদিয়ান হয়ে বসলেন।
দেবী সিং কে? জাহেদা জিগ্যেস করল।
প্রণব বাবু বাবর আর জাহেদার মাঝখানে মাথা এগিয়ে বললেন, দেবী সিং? সে এক নররূপী রাক্ষস। রক্ষসের তবু ক্ষুধার তৃপ্তি আছে, তার ছিল না। তার অত্যাচারে প্রজাকুল জর্জরিত হয়ে উঠেছিল। বাবর সাহেব জানেন না বোধহয়, এই রংপুরেই প্রথম কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। ব্যাস, এই আমার বাড়ি মশাই, এইখানে রাখুন।
দরোজা খুলে চটি ফটফট করে এগিয়ে গেলেন পুরনো খোয়া ওঠা বিশাল দুটো থামের দিকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ডাকলেন, কইরে, রামটহল ব্যাটা কুম্ভকর্ণ। ওঠ, ওঠ। লণ্ঠনটা ধর। এই যে আসুন, সাবধানে, সিঁড়ির একটা দিক ভাঙ্গা আছে।