কী দেখছ?
প্ৰায় পলকে লাফিয়ে সোজা হলো জাহেদা। বলল, দেখছিলাম।
প্রণব বাবু বললেন, আরো দেখুন দিদি, এই যে পেতলের ধুপপাত্র দেখছেন এটি ডিমলার মহারাজা দান করেছিলেন। অতি প্ৰাচীন বস্তুটি। অনুমান করা হয রাজা রামপালের সময়ের। সম্ভবত এই পাত্র দেবীর আরাধনাকালে ব্যবহার করা হতো। দেবদাসীরা নৃত্য করতেন এই ধুপপাত্র কোমল লীলায়িত হস্তে ধারণ করে।
জাহেদা বলল, আই সি।
বাবর তাকে সাততাড়াতাড়ি বলল, জাহেদা, তোমাকে আমি রামপালের কাটা দীঘি রামসাগর, বলেছি না?
বলতে বলতে তাকে নিয়ে বাইরে এলো সে। প্রণব বাবু বলল, চলুন লাইব্রেরিতে যাই। বোধহয় সবাই এসে গেছেন।
আরো কয়েকজন এসে পৌঁছেছেন। দলটা বেশ ভারি হয়ে উঠেছে। জনা ত্ৰিশ পঁয়ত্রিশ হবেন। প্রণব বাবু হাত ধরে বাবরকে ভাল চেয়ারটায় বসালেন। জাহেদাকে বললেন, বসতে আজ্ঞা হোক দিদি। তারপর করজোড়ে সবাইকে উদ্দেশ করে নিবেদন করলেন, আপনারা আসন গ্রহণ করুন। এটা কোনো বিধিবদ্ধ সভা নয়, সংবর্ধনা হিসেবেও এ আয়োজন অতি সামান্য, আমরা সম্মানিত অতিথির সঙ্গে আলাপ করবার মানসে মিলিত হয়েছি। তার মত মহৎ একজন সংস্কৃতিসেবীর কাছ থেকে দুচার কথা শুনে। ধন্য হব। সুধীবৃন্দ, আপনারা আসন গ্ৰহণ করুন।
শিশুর মত কৌতূহল নিয়ে জাহেদা তাকিয়ে রইল। বারান্দায় যারা ছিলেন তাঁরা এসে বসলেন। তরুণেরা প্রৌঢ় এবং বৃদ্ধদের জন্যে সমুখের আসনগুলো ছেড়ে দিল। বাইরে পেয়ালা পিরীচের শব্দ হতে লাগল টুং টাং। বাবর বুঝল, চায়ের ব্যবস্থাও হয়েছে।
প্রণব বাবু একটু থেমে গলা পরিষ্কার করে বলে চলেছেন, অলমতিবিস্তরেণ। সুদূর রাজধানী ঢাকা থেকে আমাদের এই নগণ্য শহরে বাবর আলী সাহেব তাঁর সহোদরাকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। আমরা তাঁর সান্নিধ্যলাভের এই সহসা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে চাইনি বলেই এই মিলন-সভার আয়োজন। সম্মানিত অতিথির পরিচয় নিষ্প্রয়োজন। দেশের এই ক্রান্তিকালে নিঃশব্দ দীপাবর্তিকার মত যে কয়জন সংস্কৃতিসেবী এ দেশের অন্ধকারে আলো দিয়ে চলেছেন ইনি তাদেরই একজন।
জাহেদা প্রশ্ন-চোখে বাবরের দিকে তাকাল। একবৰ্ণ সে বুঝতে পারছে না। বাবর তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল এবং আবার হাতের দশ আঙুল ডগায় ডগায় ছুঁইয়ে একটা শোভন ভঙ্গি ধারণ করে অবনত মস্তকে বসে রইল।
প্রণব বাবু বলছেন, ইনি যখন যেখানে অবস্থান করেন সংস্কৃতির একটা সুবাতাস সেখানে প্রবাহিত হয়ে যায়। আমরা আজ এই মহতী সন্ধ্যায় যে যার কাজ ফেলে ক্ষণকালের জন্যে হলেও এই সুফলা শস্যশ্যামলা স্বদেশের সাহিত্য-শিল্প সংস্কৃতির দিকে যে মনঃসংযোগ করেছি তা এই বাবর আলী সাহেবের অসাধারণ ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে, সম্মোহনে। বন্ধুগণ, কিমত্ৰ চিত্ৰং যদি বিশাখে শশাঙ্কলেখামনুবৰ্ত্ততে?–অর্থাৎ বিশাখা তারা দুটি যে সর্বদাই চন্দ্রের অনুকরণ করবে, অনুসরণ করবে, এত আশ্চর্যের কী আছে? প্রণব বাবু স্নিগ্ধ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে সস্নেহে সবার ওপর চোখ বুলিয়ে আনলেন। তারপর বললেন, ইনি একজন সুনিপুণ বক্তা। এর বক্তৃতার অনায়াস ভঙ্গি, যুক্তির অপূর্ব ঋজুতা—
জাহেদা বলল, কী বলছেন উনি?
বাবর নীরবে হাসল এবং শুনতে পেল তাকে এবার প্রবন্ধকার, সমালোচক, দার্শনিক ইত্যাদি একের পর এক বলা হচ্ছে। অভিভূতের মত তাকিয়ে আছে জাহেদা। একাগ্র হয়ে প্রণব বাবুর বক্তৃতা শুনছে উপস্থিত সকলে। মাথার ওপরে জ্বলছে কড়া শাদা আলো। চারদিকের আলমারিতে সার সার বই, নীল সবুজ হলুদ কাপড়ে বাঁধান, ক্রমিক সংখ্যার টিকিট সাটা। একটা টিকটিকি কাচের ওপর পেট চেপে স্থির হয়ে আছে।
বাবরের হঠাৎ কথাটা মনে হলো। ফিসফিস করে হেসে বলল, জাহেদা, তখন স্বপ্ন আর বাস্তবের কথা বলছিলাম।
জাহেদা মাথা ঝুঁকিয়ে নীরবে সায় দিল।
স্বপ্ন থেকে বাস্তবের কোনো তফাৎ নেই। বাবর নিচু গলায় বলে চলল, একটা বাঘ মনে কর হরিণকে দেখতে পেয়েছে। সে স্বপ্ন দেখল ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার ওপর, এবং তক্ষুণি ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। দুয়ের মধ্যে এক পলেরও কম ব্যবধান। আসলে স্বপ্ন হচ্ছে ভবিষ্যৎ। কিন্তু ভবিষ্যৎ আসলে বর্তমানেরই সম্প্রসারণ।
বাবর থেমে থেমে বলছিল এবং ফাঁকে ফাঁকে সভার দিকেও তাকাচ্ছিল। এক সময়ে দেখল সভার ভেতর থেকে একজন উঠে স্থানীয় সাংস্কৃতিক কার্যাবলীর বর্ণনা দিতে শুরু করলেন। বক্তা অত্যন্ত আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বর্ণনা করে চলেছেন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কী কী বাঁধার সম্মুখীন তারা প্রতিনিয়তই হন। একটা টুকরো কানে এলো এখন বাবরের—
রবীন্দ্র-বিরোধী দল এখানেও বেশ ভারি। এবং তাদের অনেকেই আমাদের মুরুকিব। মফঃস্বলে অসুবিধা এই মুরুব্বিদের বিরোধিতা প্রকাশ্যে করা যায় না। এখানে সবাই আমাদের বাবা-চাচা কিংবা বাবা-চাচার মত। বাবা-চাচার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারপর ধরুন— বর্ষা। সেবার বর্ষ উপলক্ষে আমরা একটি গান ও কবিতার আসর করতে চেয়েছিলাম। সবাই হাঁ হাঁ করে উঠলেন, আমরা হিন্দু হয়ে গেছি। বর্ষার গানের আসর করলে যদি সেই হিন্দু হয়ে যায়, তাহলে ঈদের নামাজ পড়লেই মুসলমান তাকে বলতে হবে?
সহাস্য দুঃখিতভাবে মাথা নাড়লেন সবাই।
বক্তার কণ্ঠ আবেগে আরো ঘন হয়ে উঠল।
জাহেদা জিগ্যেস করল চাপা গলায়, তখন কী একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন বলছিলেন।
হ্যাঁ।
দেখেছিলাম, মিসেস নাফিস, তাকে চেনো? না, তুমি চিনবে না। তাকে দেখি ঢাকার রাস্তা দিয়ে এক ষাঁড়ের পিঠে চড়ে যাচ্ছেন। সম্পূর্ণ উলংগ। কিন্তু সেটাই যেন স্বাভাবিক। কেউ ফিরেও দেখছে না। যে যার মত চলে যাচ্ছে।