বাবর হাসল।
যান, মুখ ধুয়ে নিন। চা আনতে বলেছি।
বাথরুমে এসে দেখল জাহেদার পাজামা ঝুলছে হুক থেকে। স্তম্ভিত নিঃশ্বাসে সে একবার তাকিয়ে দেখল, তারপর কম্পিত হাতে স্পর্শ করে রইল ঠিক যেখানে জাহেদার রাজহাঁসটা লুকিয়ে থাকে। জাহেদা যখন হেঁটে যায় তখন পেছনটা দেখায় ঐ রকম। সুতোর, মাড়ের, সাবানের, সুগন্ধের স্তব্ধ উষ্ণ একটা অনুভব। পাজামাটা আবার ঝুলিয়ে রেখে মুখ ধুল বাবর। মুখ মুছল জাহেদার তোয়ালে দিয়ে। টাক ঢেকে সিথি করে জাহেদার স্প্রে ব্যবহার করল।
বেরিয়ে দেখে চা নিয়ে বসে আছে জাহেদা।
বাবর বলল, ঘুমিয়ে একটা স্বপ্ন দেখলাম এখন।
জাহেদা হেসে বলল, আপনি জেগেও স্বপ্ন দেখেন নাকি?
হ্যাঁ দেখি। এই যে তুমি, আমি, কোথাকার কোন রংপুরের ডাকবাংলো, এই চা খাচ্ছি, এটা স্বপ্ন নয়?
আবার বক্তৃতা।
আমার অভ্যাস। বাবর হেসে ফেলল।
এটা তো টিভি নয় যে বক্তৃতা দিলে পয়সা পাবেন।
যা পাচ্ছি সেটা টাকার চেয়ে বড়।
কথা ঠিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক জায়গায় আনতে আপনার দ্বিতীয় নেই।
নিঃশব্দ হাসিতে উজ্জ্বল হলো বাবর। দরোজায় টোকা পড়লে চমকে তাকাল। দরোজা খুলে দেখল, প্রণব বাবু দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে টুক টুক করছে পান। হাতে চুন লাগান বোটা। দেখা হতেই চিবুক তুলে, যাতে রস গড়িয়ে না পড়ে, বললেন, বিশ্রাম হলো? হলো। আসুন। জাহেদা, এই প্রণব বাবু।
প্রণব বাবু নমস্কার করলেন।
চলুন তাহলে, আপনাদের জন্যে ব্যবস্থা করে এলাম।
ব্যবস্থা মানে?
এই একটু লোকজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করবেন। কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যানুরাগী সংস্কৃতিমনা ভদ্রলোককে খবর দিয়েছি। ওরা সবাই পাবলিক লাইব্রেরীতে আসবেন। পাশে বহুদিনের গৌরবময় রংপুর সাহিত্য পরিষদ আছে সেটাও এক নজর দেখে নেবেন। ব্যস।
করেছেন কী? বাবর চোরচোখে জাহেদার দিকে তাকাল।
প্রণব বাবু জাহেদার দিকে তাকিয়ে বললেন, বুঝেছেন দিদি, কোনো রকমে সংস্কৃতির সলতে টিমটিম করে জ্বালিয়ে রাখা যাচ্ছে, রংপুরেব সেদিন নেই, সেই মানুষও নেই, তবু কয়েকজন আছেন, বিশেষ উৎসাহী, একেবারে নিবেদিত প্ৰাণ। ঢাকা থেকে এসেছেন, তাদের সঙ্গে আলাপ করে না গেলে মনে বড় ব্যথা পাবেন তারা। ন খলু ন খলু বানঃ সন্নিপাতোহয়মস্মিন মৃদুনি মৃগ-শরীরে তুলরাশবিবাগ্নিঃ। শেষাংশে সংস্কৃতটুকু তিনি বাবরের উদ্দেশে বললেন।
একে ঐ রকম বাংলা তার ওপর সংস্কৃত, বাবর যার একবর্ণ নিজেও বোঝে না, শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল জাহেদা। বাবর নিজে তার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে। বাংলা কখনো বললে তার কঠিন শব্দটা সঙ্গে সঙ্গে তর্জমা করে দেয়। প্রণব বাবু তা দুঙ্গীনবেন কোত্থেকে? তিনি ভেবেছেন, জলের মত স্বচ্ছ তরল তার বাংলা না বোঝার কী আছে? জাহেদাকে বিব্রত হওয়ার হাত থেকে বাচাল বাবর। বলল, চলুন তবে বেরোই। চল জাহেদা।
বেরিয়ে এক ফাঁকে জাহেদার কানে কানে সে বলল, চুপচাপ থাকবে। বোঝার ভাণ করবে। আর তোমাকে আমার বোন বলেছি। ওঁর বাসায় খেতে যেতে হবে কিন্তু।
ডাকবাংলো থেকে বেরিয়ে অল্প একটু গেলেই রাস্তার ওপারে পাবলিক লাইব্রেরী। সমুখে মস্ত মাঠ। আঁধারে ঢেকে আছে এখন। ভুতের মত এক আধটা লোক চলাচল করছে। খোলা দরোজায় লালচে আলো পর্দার মত ঝুলে আছে। মাঠের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগল ওরা। মুর্খানে একূটা বাঁধান বেদির ওপরে খুঁড়ে পাওয়া প্রাচীন কোনো দেবীমূর্তি যেন সন্ধ্যা শাসন করছে। প্রণব বাবু অনর্গল বলে চলেছেন রংপুরের ইতিহাস, এই লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার ইতিহাস–এখানকার প্রতিটি বস্তু এবং মানুষের ইতিহাস যেন তার নখদর্পণে।
বারান্দায় দেখা গেল। কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। প্রণব বাবু তাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন বাবরের। ভেতরে সে দেখতে পেল শাদা চাদরে ঢাকা একটা টেবিল, তার মাঝখানে স্নিগ্ধ ফুলের স্তবক, সমুখে কিছু ভাঁজ খোলা চেয়ার। প্রণব বাবু আজ না ড়ুবিয়ে ছাড়বেন। না। এযে একেবারে একটা সভার আয়োজন। বাবর একটু সন্ত্রস্ত একটু সংকুচিত বোধ করল। পাগলের পাল্লায় পড়া বোধহয় একেই বলে।
প্রণব বাবু বললেন, আরো কিছু সুধী আসবেন, এই এসে পড়লেন বলে, চলুন ততক্ষণে সাহিত্য পরিষদটা ঘুরে আসি। জাহেদাকে বললেন, দিদি, একটু অন্ধকার বটে সাবধানে পা ফেলবেন।
বাবর পকেট থেকে মিনিলাইটটা বের করল। সেদিন কেনার পর আজ এই প্ৰথম ব্যবহাব হচ্ছে। মাকড়শা জালের মত ফিনফিনে একটা আলো পড়ল ঘাসের ওপব। জাহেদার হাতে দিয়ে বলল, এটা তোমার কাছে রাখ।
ছোট্ট, ঠাণ্ডা, স্যাঁতস্যাঁতে, পরতের পর পরত ধুলো জমা, স্বল্পালোকিত একটা ঘর। মিটমিট করে বাতি জ্বলছে মাথার ওপর। এই সাহিত্য পরিষদ। দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে চারদিকে রাখা সব প্রাচীন মূর্তি মূর্তির ভগ্নাংশ। স্তুপ স্তুপ পুঁথি। একহাঁটু ধুলো তার ওপর। ন্যাকড়া দিয়ে জড়ান কোনোটা। কোনোটায় কাঠের পিড়ি দিয়ে মলাট।
এত পুঁথি এখানে? বিস্ময়ে প্রায় শিষ দিয়ে উঠল বাবর। এবং পরীক্ষণে চৈতন্য হলো তার, শিষটা স্থানোপযোগী হলো না।
কে একজন জবাব দিলেন, আরো বহু পুঁথি ছিল, কিছু নষ্ট হয়েছে, কিছু হারিয়ে গেছে। বহুদিনের বহুকালের সংগ্রহ এসব
দেখতে লাগল বাবর। হঠাৎ দেখে পাশে জাহেদা নেই। ঘরের মাঝখানে প্রশস্ত তাকের জন্য ওপাশে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেবল ঝর্ণার মত অবিরল প্রণব বাবুর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। কান খাড়া করে বাবর টের পেল, জাহেদাকে তিনি একেকটা সংগ্রহের পরিচয়, ইতিহাস ইত্যাদি বলে চলেছেন। আস্তে আস্তে কাছে গেল বাবর। তার সঙ্গে যারা ছিল তারাও অনুসরণ করলেন। বাবর দেখল একটা ভাঙ্গা বিষ্ণু মূর্তি নত হয়ে দেখছে জাহেদা সেই মিনিলাইট জ্বালিয়ে। সমস্ত পেছনটাকে একটা বিরাট বলের মত মনে হচ্ছে। প্রায় স্পর্শ করে রয়েছে দুই হাঁটু। ফলে চমৎকার একটি জীবন্ত ত্রিভুজের সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। বাবর তার সঙ্গীদের দিকে একবার দেখল। এবং তার ভেতরে একটা তীব্র ইচ্ছে লাফিয়ে উঠল এই বাঁঝাল ধুলি গন্ধ স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে জাহেদাকে পেতে, তার শাদা ঐ পোশাকটার ভেতর থেকে শরীরটাকে জন্মদিনের চিঠির মত খুলে ফেলতে। সে টোকা দিল জাহেদার পিঠে।