বাবর বলল, মৃত্যুকে তুমি ভয় পাও?
আমি মরতে চাই না।
কেউ চায় না–পাগল, প্রেমিক, কবি ছাড়া।
তা জানি না। আমি বেঁচে থাকতে চাই।
কিন্তু মৃত্যুই তো নিয়ম।
বুঝি না।
মৃত্যুকে যেভাবেই দ্যাখ জাহেদা, পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাভাবিক এই মৃত্যু। যদি একটা কোনো অনড় অবিচল সত্য থেকে থাকে তো তা মৃত্যু।
দোহাই আপনার, চুপ করন।
সত্য আর স্বাভাবিক থেকে তুমি কেন পালাবে জাহেদা?
আহ আমি শুনতে চাই না।
অব্যক্ত যন্ত্রণায় জাহেদা মাথা এপোশ ওপাশ করতে লাগল। সুদক্ষ গলফ খেলোয়াড় যেমন সন্তৰ্পণে টি-তে বল ঢোকায়, তেমনি যত্ন এবং দৃঢ়তার সঙ্গে বাবর গাড়িটা ডাকবাংলোর ভেতর আনল। পরমশীলতার সঙ্গে দরোজা খুলে দিল জাহেদার। এবং নিঃশব্দে অনুসরণ করতে লাগল দোতলার দিকে। জাহেদা একটু দ্রুত হাঁটছে। একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে দুজনের ভেতরে দূরত্ব আরো বেড়ে গেল। কিন্তু সিঁড়ির কাছে গিয়ে অপেক্ষা করল জাহেদা। তখন আবার পাশাপাশি হলো তারা। এক সাথে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।
দোতলায় উঠেই দেখে প্রণব বাবু দ্রুতগতিতে বারান্দায় পায়চারি করছেন। পরনে শাদা খদ্দরের মোটা পাঞ্জাবি, সাদা জহর কোট, পাট ভাঙ্গা ধুতি, পায়ে লাল চটি। মাথায় রূপালি একরাশ তরঙ্গায়িত চুল ঝিকঝিক করছে। পাতলা ঠোঁটে সহাস্য পানের ছোপ।
বাবর ফিসফিস করে জাহেদাকে বলল, তুমি ঘরে যাও। প্রণব বাবু ততক্ষণে পায়চারি করে উল্টোদিকে ফিরতেই বাবরের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। শরৎ কালের মেঘের মত হাসতে হাসতে কাছে এসে প্রণব বাবু হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, কী সৌভাগ্য! মশাই দোকানে আপনার চিঠি পেয়েই সেই থেকে পায়চারি করছি।
তাই নাকি?
আরে হ্যাঁ। একবার ভাবি চলে যাই, পরে আসব। আবার ভাবি দেখিই না একটু। সেই যে অভিজ্ঞান শকুন্তলম-এ আছে— গচ্ছতি পুরঃ শরীরং ধাবতি পশ্চাদ সংস্থিতং চিতঃ। চীনাংশুকামিব কেতোঃ প্ৰতিবাতংনীরমানস্য। অর্থাৎ কিনা যাচ্ছি বটে, মন পেছনে পড়ে রইছে, যেন নিশান যাচ্ছে সমুখে, পতপত করছে পেছনে। হাঃ হাঃ। আছেন কেমন?
ভাল। এলাম। আপনাদের দেশ দেখতে।
খুব ভাল করেছেন, খুব ভাল করেছেন। আমি মশাই সৰ্বক্ষণ আপনার কথা চিন্তা করি। এই কালও কাকে যেন বলেছিলাম। চলুন, কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবেন, নিয়ে যাই আপনাকে। সঙ্গে মহিলা দেখলাম।
আমার বোন।
বা বা বা। প্রীত হলাম। তাহলে দয়া করে একবার গরিবের বাড়িতে পদধূলি দিতে হয়। চাট্টি খাবেন।
নিশ্চয়ই। আপনার নিরামিষ খাবার গল্প কত শুনেছি।
মশাই, সাত পুরুষের অভ্যোস। সাত পুরুষ থেকে নিরামিষাশী। আপনাদের কেমন লাগবে জানি না, তবে যত্নের কোনো ক্রটি রাখব না। হাঃ হাঃ। আজ রাতে?
হ্যাঁ, আজ রাতটা আছি। আজ রাতে মন্দ কী।
সেই ভাল। বসে বেশ গল্প গুজব কিবা যাবে। অনেক দিন থেকে মশাই আড্ডার জন্যে প্ৰাণটা আইটাই করছে। এখন কী করছেন?
এই বাইরে থেকে বেড়িয়ে এলাম। তাহলে যান মশাই, স্নানাহার করে নিন, একটু বিশ্রামও হোক। আমি ও-বেলা আসব। এই চারটের সময়?
সে-কী! একটু বসবেন না? একটু বসুন। কদিন পর দেখা।
তাতো বটেই। তবে কিনা দ্বিপ্রাহরিক আহামের সময়। চোখের দেখা হয়ে গেল, মনটাতে আর আক্ষেপ নেই। আপনি আরাম করুনগে। ঐ কথাই রইল। রাতে গরিবালয়ে চাট্টি খাবেন। ন চেন্দন্যকাৰ্য্যাতিপাতঃ প্রবিশ্য প্রতিগুহ্যতামাতিথেয়ঃ সৎকারঃ। আর বিকেলে আমি আসছি।
পিঠ চাপড়ে দিয়ে চটি ফটফট করতে করতে প্রণব বাবু চলে গেলেন। যেন একটা নির্মল আনন্দ কোথা থেকে হঠাৎ মনটাকে আলোকিত করে চলে গেল। তিন পুরুষ আগে এখানে জমিদারি কিনেছিলেন ওরা। এখন শুধু শীলতাটুকু আছে। মাঝে মাঝে জন্মভূমি বারানসিতে যান, ছেলেমেয়েরা সব সেখানেই, কিন্তু নিজে থাকতে পারেন না। রংপুরে পড়ে থাকে মনটা। জমিজমার কাজে হাইকোর্ট সেক্রেটারিয়েট আছে, সেই সূত্রে ঢাকা যেতে হয়। একবার এক ভাওয়াইয়া গায়কের সঙ্গে টেলিভিশনে বেড়াতে এসেছিলেন প্রণব বাবু। সেই তখন আলাপ। প্রথম আলাপেই ভারি ভাল লেগেছিল তাঁকে, বিশেষ করে ঐ সংস্কৃত উচ্চারণগুলো ভারি চমৎকার শোনায়। কতবার বলেছেন, রংপুরে এলেই মশাই আমাকে স্মরণ করবেন।
চৌকিদারকে খাবার আনতে পাঠিয়ে ঘরে ঢুকল বাবর। দেখল জাহেদা ছোট্ট আয়না তুলে মুখ দেখছে। জিগ্যেস করল, চলে গেলেন?
হ্যাঁ।
এই রকম চুল শাদা বুড়ো আপনার বন্ধু?
আমিও তো বুড়ো। হাসতে হাসতে বাবর খাটের ওপর বসল। যোগ করল, বুড়ো নাই? তুমি যে তখন বলছিলে।
জাহেদা ভ্রুকুটি করে তাকাল। তারপর আয়নার দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, আমার কথা জিগ্যেস করেনি?
করেছে।
পরিচয়টা কী দিলেন?
নিঃশব্দে সব কটা দাঁত বের করে হাসল বাবর। জাহেদা আবার চোখ কালো করল। নিঃশব্দে সালতামামী করতে লাগল চেহারার। বাবর একটা সিগারেট ধরাল। খাবার এলে খেল ওরা দুজন। খেতে খেতে নেমন্তনের কথা জানাল বাবর। খাওয়া শেষে জাহেদা বলল, আপনি বাইরে যান।
কেন? বাইরে কেন?
আমি একটু শোব। যান।
বাবর আবার নিঃশব্দে হাসল। তারপর বনবেড়ালের মত পায়ে আরাম চেয়ারটা বাইরে এনে বসল।
১৬. আকাশটা লাল
বাবর চোখ খুলে দেখে আকাশটা লাল হয়ে উঠছে। আরাম চেয়ারে শুয়ে ঘাড়টা ব্যথা করছে তার। পাশে তাকিয়ে দেখে, জাহেদা। তখন বুঝল জাহেদা তার ঘুম ভাঙ্গিয়েছে। দুপুরের পোশাকটা পালটে শাদা জামা পাজামা পরেছে। তাতে কালো বর্ডার দেয়া। চুল পিঠের পরে ছেড়ে দেয়া, কাঁধের নিচে ডোল হয়ে আছে।