কেন?
নিজের মেয়ে বড় হোক তখন বুঝবেন। ভাবছি হোস্টেলে গিয়ে আপনার নাম ভিজিটারদের খাতায় তুলে দিয়ে আসব।
কিন্তু যে বললেন লতিফার বিয়ে দিচ্ছেন। বিলেত যাচ্ছে।
ওহো! এই দেখুন। একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। বলে হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসতে লাগলেন কাজী সাহেব। বাবর বুঝতে পারল হুইস্কি কাজ করতে শুরু করেছে। কাজী সাহেব নেশার আমেজে কী বলতে কী বলছেন। কাজী সাহেব বললেন, আমার জামাইটা খুব ভাল হচ্ছে।
নিশ্চয়ই।
নিজের জামাই বলে বলছি না।এ-কী আপনার গ্লাস খালি, বেয়ারা জলদি দাও।
আপনি?
আমিও নেব। কী বলছিলাম?
বলছিলেন। আপনার হবু জামাইয়ের কথা।
দুটো ছোট ছোট দ্রুত চুমুক দিয়ে কাজী সাহেব বললেন, হবু বলছেন কেন? জামাই হয়েই গেছে। বড় ভাল ছেলে। অমন ব্ৰিলিয়েন্ট ছেলে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। আমার অনেকদিন থেকেই চোখ ছিল ছেলেটার ওপর।
আপনার তো আত্মীয়ের মধ্যেই?
জি, আমার এক কাজিন শালীর একমাত্র ছেলে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পড়তে যাচ্ছে। লতিফাকেও নিয়ে যাবে।
বাবর অত্যন্ত সাবধান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, লতিফা কী বলে।
ওতো বিলেত যাবার নামে ওড়ে।
না, বিলেতের কথা বলছি না।
তবে?
এত অল্প বয়সে–মাত্র তো সতের–বিয়ে হচ্ছে, তাই বলছিলাম।
তা বিয়ের জন্যে বয়েসটা একটু কম। সেজন্য আমিও ঠিক সাহস পাচ্ছিলাম না। কামাল ওর মাকে বলেছিল–
কামাল কে?
কেন, আমার জামাই!
ও, বলুন।
কামাল ওর মাকে বলেছিল বিয়ে করলে লতিফাকেই করবে। ওর মা বিলেত যাবার আগে ছেলের বিয়ে নিয়ে চাপাচাপি করেছিলেন কি-না তাই।
তারপর?
কাজী সাহেব আরেকটা বড় চুমুক দিলেন গ্লাসে। মুখটা মুছলেন। তারপর চোখ স্তিমিত করে বললেন, অনেকদিন পরে খাচ্ছি কি-না তাই কেমন কেমন লাগছে।
সে-কী, মাত্র দুপেগ তো খেয়েছেন।
আমি খাই-ই কম। আপনি নিন।
নেব। এটা খালি হোক। এখানে চিপস-টিপস কিছু—
বেয়ারা, চিপস।
সে বলল, চিপসের তো ব্যবস্থা নেই।
যেখান থেকে পার ব্যবস্থা কর। প্রায় হুংকার দিয়ে উঠলেন কাজী সাহেব। তার এ মূর্তি বাবর দেখেনি। উনি যে কাউকে ধমক দিতে পারেন সেটা একেবারে অচিন্তনীয়। অপ্রস্তুত হয়ে গেল বাবর। বলল, থাক না, আমি এমনি বলেছিলাম।
না, থাকবে কেন? ড্রিংসের সঙ্গে চিপস নেই। সেক্রেটারীর কাছে কমপ্লেন করব। আবার কেমন বেয়াদপ, মুখের উপর কথা বলে। তুমকো হাম দেখা লেগা।
আরে, করছেন কী?
এই তুমহারা বাড়ি কাঁহা? কাজী সাহেব ধমক দিয়ে উঠলেন আবার।
জি, রাজশাহী।
রাজশাহী।
রাজশাহী কাহাঁ?
চাঁপাই নবাবগঞ্জ, হুজুর।
চল, তব ঠিক হ্যায়। বলে তাকে রেহাই দিলেন কাজী সাহেব এবং মুখ ফিরিয়ে বাবরকে বললেন, আমার দেশেরই লোক কি-না, তাই ছেড়ে দিলাম।
বেশ করছেন। আপনারা তাহলে রাজশাহীর?
হ্যাঁ। আপনি?
বর্ধমান।
পাটিশনের পর ঢাকায় এসেছেন?
ঠিক পার্টিশনের পর নয়। ১৯৫৪ সালে।
খুব অবাক কাণ্ড।
অবাক কীসের?
আরে, চাকরি নিয়ে আমার প্রথম পোস্টইং যে ছিল বর্ধমানে।
তাই নাকি?
তবে আর বলছি কী! খোকার জন্ম হয়। বর্ধমানে।
আর লতিফার?
চাঁটগায়ে।
আর ছোটটি?
মন্টুর কথা বলছেন? ওটি খাস ঢাকাইয়া। আপনি বিয়ে করেছেন কোন ডিস্ট্রীক্টে?
সত্যি মিথ্যের চাষ যাকে বলে আজ তাই হচ্ছে। বাবর একটু স্মিত হেসে সলজ্জ হবার অভিনয় করে সময় নিল। তারপর বলল, ঢাকাতেই।
তাহলে এক হিসেবে আপনিও ঢাকাইয়া। কী বলেন?
ভারি আমোদের একটা কথা যেন তিনি বলেছেন এমনিভাবে দুলে দুলে হাসতে লাগলেন কাজী সাহেব। বেয়ারা তার গ্লাশটা ভরে দিল। আর সে বকুনি খাবার ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।
কিন্তু বাবরের এখনও জানা হলো না, বিয়েটা ঠিক হলো কী করে? আর লতিফার প্রতিক্রিয়াই বাঁ কী? বাপ মা কি তাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে? খুব সম্ভব। তাই। কারণ, লতিফা এই সেদিনও বলছিল, বিয়ে সে জীবনে করবে না। এই এক মাসের মধ্যে এমন কী হয়ে গেল?
কথাটা কীভাবে তোলা যায়। ভাবতে লাগল বাবর। চারদিকে তাকাল সে। একেবারে নীরব নিঝুম সারা ক্লাব। ভেতরে শুধু তারা দুজন। বাইরেও কেউ নেই। বাবর জিজ্ঞেস করল, বিশেষ কাউকে দেখছি না।
দেখতেন। আগে এলে দেখতেন। কী জমজমাট থাকে।
এখন কী হয়েছে?
চারদিকে যেমন আন্দোলন চলছে সাহেব, সবাই সন্ধ্যের পর ঘর থেকে আর বেরোয় না। বিশেষ করে সরকারি কর্মচারীরা। তাদের কীর্তির তো অন্ত নেই সাহেব। ভয়ে, স্রেফ ভয়ে বাসায় বসে থাকে।
ও।
হাসল বাবর। লতিফার কথাটা তোলা যায় কী করে? একটু পর সে আবার চেষ্টা করল, মেয়েরা আসে না ক্লাবে?
ব্যবস্থা তো আছে। মেয়েদের জন্যে আলাদা একটা কামরাও রাখা আছে। কিন্তু সপ্তাহে এক আধাদিন ছাড়া আসে না। আর সময় কই বলুন? ঘর সংসার ছেলে মেয়ে সবারই তো এক অবস্থা।
এবারে আশার আলো দেখতে পেল বাবর। বলল, ছেলেমেয়েদের আপনি খুব ভালবাসেন, না?
ছেলেমেয়েরাই আমার সব। লতিফাকে তো চেনেন, ওকে দেখলেই বুঝতে পারবেন, কী আদরে ওদের বড় করেছি আমি।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন কাজী সাহেব। তারপর গ্রাশের দিকে চোখ রেখেই তন্ময় কণ্ঠে বললেন, বিয়ে দিলেই মেয়ে পর হয়ে যায়। তবুও বিয়ে দিচ্ছি। ভাবতে এখনই আমার খারাপ লাগছে।
আর কিছু দিন পর না হয় বিয়ে দিতেন। ছেলেটা ভাল। তাছাড়া, কদিনই বাঁ বাঁচব। বেঁচে থাকতে থাকতে সব বিলিব্যবস্থা করতে পারলে শান্তিতে মরতে পারব।
এটা স্বার্থপরের মত বলছেন।
তা। আপনি বলতে পারেন।
তাহলে কেন দিচ্ছেন?