বাবর চুপ করে রইল।
আপনার মেয়ের নাম কী রেখেছেন? চমকে উঠল বাবর। আরো একটা মিথ্যে কথা বলতে হবে তাকে। সে বলল, বাবলি।
বাবলির কথাই একটু আগে সে ভাবছিল।
বাহ, ভারি সুন্দর নাম। ভাল নাম কী?
বাবলি বাবর।
অবলীলাক্রমে সে বানিয়ে ফেলল। নামটা। বানিয়ে ভারি পছন্দ হয়ে গেল! তাই আবার সে উচ্চারণ করল, বাবলি বাবর। আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে রেখেছি।
খুব সুরেলা নাম। কবছর যেন বয়েস হলো?
এখন পাঁচ।
যাক, আরো অন্তত বছর পনের কাছে পাবেন। তার পরই মেয়ে আপনার পর।
বিয়ে দিলেই মেয়ে পর হয়?
কী জানি, আমার যেন তাই মনে হয়। আমি কিন্তু আপনার পছন্দ ঐ ডিজাইনেরও একটা সেট বানিয়ে দেব।
নিশ্চয়ই।
ক্লাবের সামনে এসে পড়ল তারা। কাজী সাহেব গাড়ি একটা মনমত কোণে রাখতে রাখতে বললেন, সাধারণত ক্লাবে আসি না। অনেকদিন পরে আজ আসছি। তা প্ৰায় মাস তিনেক হবে।
শুধু শুধু তাহলে এসে কী দরকার ছিল?
শুধু শুধু কেন? আপনি আছেন যে। মনের মত লোক না পেলে এখানে এসে দুদণ্ড বসা যায় না। ছোট শহর। বসলেই পরিচর্চা আর চাকরির গল্প, ভাল লাগে না সাহেব। পরিচর্চার মত সুস্বাদু আর কিছু নেই যে।
খুব ভাল বলেছেন পরিচর্চা যারা করে তাদের আমি এক মুহুর্ত সহ্য করতে পারি না।
ক্লাবটা ভারি সুন্দর। নিচু একতলা লম্বা দালান। সামনে পেছনে বাগান। খেলার জায়গা। বসবার কোণ।
বাইরে বসবেন, না ভেতরে?
বাইরের বসি।
বাইরে বেশিক্ষণ বসা ঠিক হবে না।
কেন?
ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে যে! ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
আপনাদের বাথরুমটা কোথায়?
এতক্ষণ একবারও যাবার সুযোগ হয়নি। পেটটা ফুলে রয়েছে। লতিফাদের বাসাতেই লেগেছিল। কিন্তু ভদ্রতা করে বলেনি।
ঐ তো বাঁ ধারে, সোজা চলে যানে। সুইচ ঠিক দরোজার বাইরেই আছে। যান।
বাবর গেল। বাতি জ্বলিয়ে ভেতরে ঢুকল। আয়নায় নিজেকে দেখল। খানিক। অহেতুক মাথায় পাকা চুলের সন্ধান করল সে। থাকলেও রাতে তা চোখে পড়ল না। গালের দুপাশে ডলল কয়েকবার। সেভ ঠিকই হয়েছে। ট্রাউজারের বোতাম খুলল সে! ঘণ্টা সাতেক প্রস্রাব করা হয়নি। হলুদ হয়ে গেছে রং। যন্ত্রটাও বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রায় ভীমাকার ধারণ করেছে। ভারমুক্ত হবার পর এত আরাম লাগল যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সে একটা হাসি উপহার দিল। তারপর দ্রুত বেরিয়ে এলো বাইরে।
এদিকে আসুন। বলে একটা দরোজার দিকে হাত তুলে ইশারা করলেন কাজী সাহেব। বাবর চোখ তুলে দেখল দরোজার মাথায় সবুজ রংয়ে লেখা BAR.
সে-কী!
অভ্যোস আছে তো?
তা আছে।
তবে আর কী? আসুন, আসুন। অনেকদিন আমি নিজেও বসি না।
কী দরকার?
রেখে দিন তো দরকার। আসুন।
কাজী সাহেব তাকে ঠেলে নিয়ে ঘরে ড়ুকলেন। এক কোণে কাউন্টার। কাউন্টারের সামনে উঁচু কয়েকটা টুল। ওদিকে কয়েকটা নিচু চেয়ার। হালকা বাতি জুলছে। কাজী সাহেব বললেন, বার খোলার সময় হয়নি। বেয়ারাকে ধরে এনে খোলালাম। একটু না হয় অপেক্ষাই করতাম।
কী খাবেন?
আপনি?
আপনার পছন্দ বলুন।
হুইস্কি।
আমারও ঐ। দাও, দুটো বড়। সোডা?
না, সোডা না, পানি।
আমি আবার সোডা ছাড়া পারি না।
সোডা শেষ পর্যন্ত আপনার পেটের ক্ষতি হবে।
তাই নাকি? তাহলে আমি পানি দিয়েই।
দুটো গেলাশ সামনে রাখল বেয়ারা। ওরা টুলে পা বুলিয়ে কাউন্টারে ঠেস দিয়ে বসল। চিয়ার্স।
চিয়ার্স। আপনাকে যেন মাঝে মাঝে পাই।
ধন্যবাদ।
কিছু বলুন না? বাবর নীরবতা ভঙ্গ করল।
আপনি বলুন। আপনাদের কাছ থেকে দুটো ভালমন্দ শোনা তো ভাগ্যের কথা।
হঠাৎ কেমন রাগ হলো বাবরের। লোকটা নিজেকে এত হীন ভাবতে ভালবাসে কেন? এ কোন ধরনের আনন্দ। অথচ সত্যি সত্যি আমি যদি তাকে বলি, আপনি তুচ্ছ, আপনি সাধারণ, আমার কথা শুনুন, আমার দিকে তাকিয়ে দেখুন, তাহলে বোমা বিস্ফোরণ হবে। এই অতি ভদ্র অতি বিনয়ী লোকটাই হিংস্র ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। মানুষ কেন এ অভিনয় করে?
ভাবতেই চমকে উঠল বাবর। সে নিজেও কি একজন শক্তিশালী অভিনেতা নয়? না, না ও কথা থাক। ও কথা এখন ভাবতে চায় না। বাবর। ভাবনাটাকে ভাসিয়ে দেবার জন্য সে ঢাক ঢক করে এক সঙ্গে বেশ খানিকটা হুইঙ্কি গলায় ঢেলে দিল।
আপনি যে হঠাৎ এভাবে আসবেন, তা ভাবতেই পারিনি।
আমিও না।
ভাবছিলাম, আজকের সন্ধ্যেটা খুবই খারাপ কাটবে। দৈবের কী কাজ দেখুন, আজকের সন্ধ্যেটাই এমন হলো যে আমার অনেকদিন মনে থাকবে।
আমারও।
আপনাকে অনেকে তাকিয়ে দেখছে।
দেখছে নাকি?
দেখবে না? আপনাকে টেলিভিশনে দেখে। ওরা অবাক হয়ে গেছে, আপনি কী করে এখানে এলেন।
আর বলবেন না, ঢাকাতেও এই কাণ্ড। কোনোখানে যেতে পারি না, বসতে পারি না, একটু একা থাকতে পারি না–লোকে চিনে ফেলে।
লতিফার কাছে শুনেছি। ঢাকায় খুব পপুলারিটি আপনার। ও তো আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
বলে বাবর চাচার মত প্রোগ্রাম আর কেউ করতে পারে না।
বলে নাকি?
বলে। আপনি আছেন বলে আমার ভরসাও কম নয়। মেয়েটা একা একা ঢাকায় থাকে। জানি, কিছু একটা হলে আপনি আছেন, দেখতে পাবেন, খবর পাব।
তাতো নিশ্চয়ই।
তাছাড়া আমি জানি, আপনিও ওকে খুব স্নেহ করেন। আপনার ওখানে যায় তো মাঝে মাঝে? যায় না?
হ্যাঁ, যায়।
আমি ওকে বলে দিয়েছিলাম, ঢাকায় কোথাও যেতে হলে বাবার সাহেবের বাসায় যাবি। আর কোথাও না। বোঝেন তো বার-বাড়ন্ত মেয়ে। সব জায়গায় যেতে দিতে নেই। আমার নিকট সম্পর্কেরও দুজন আত্মীয় আছেন, আমি তাদের বাসায় পর্যন্ত লতিফাকে যেতে দিই না।