হ্যাঁ, ভাল আছি। তুমি? তুমি কেমন?
ভাল। চায়ে কতটা চিনি?
এই ছলনাটুকু ভাল লাগল বাবরের। লতিফা জানে বাবর চায়ে কতটা চিনি খায়।
এক চামচ। ব্যাস। ওতেই হবে।
বাবা, তোমাকে কতটা চিনি?
বাড়িতে তো থাকিস না জানিসও না। চায়ে আমি চিনি খাই না।
ও, মনে ছিল না।
কাজী সাহেব প্ৰীত মুখে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, জানেন বাবর সাহেব, আমার এই মেয়েটাকে আমি কত ভালবাসি।
যেন তোমার আরো দুপাঁচটা মেয়ে আছে। ঠোঁট গোল করে লতিফা বলল। বাবর জিগ্যেস করল, তুমি চা খাচ্ছ না?
না, এইমাত্র খেয়ে উঠেছি।
বিকেল চারটায় ভাত খেয়েছ?
আর বলবেন না, মেয়টা যদি কোনো কথা শোনে। শুধু অনিয়ম করবে। এইতো সারা দুপুর বাথরুমে বসে বসে পানি ঢেলেছে।
বলেছে তোমাকে!
তা নয়তো কী?
আচ্ছা। আপনিই বলুন বাবর চাচা, চুল ঘষতে, শ্যাম্পু করতে সময় লাগে না? বাবা কিছু বুঝে না।
কিন্তু ঠাণ্ডা লাগতে পারে। ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হতে পারে।
জুর আমার হয় না।
সে-কী!
জিজ্ঞেস করে দেখুন না বাবাকে, কবে আমার জ্বর হয়েছে।
কেন, ৬৬ সালে দেশে গিয়ে এক ঝুড়ি কাঁচা আমি খেয়ে যে জ্বর বাধালি। সেটা বুঝি জ্বর না!
মফঃস্বলে আমন রোদে গায়ে করে তা অভ্যোস নেই। তাই গা গরম হয়েছিল একটু।
হা হা করে হেসে উঠলেন কাজী সাহেব। বললেন, লতিফার সঙ্গে কারো পারবার উপায় নেই।
সত্যি কথা বলি বলেই পার না।
লতিফার গলায় একটু ঝাঁঝ, একটু তিক্ততা টের পেল বাবর। কেন? কেন এই উষ্মা? কার ওপর? একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সে, হঠাৎ কাপ পিরীচের শব্দে জেগে উঠল। লতিফা ট্রে গুছিয়ে ভেতরে যাবার উদ্যোগ করছে।
বাবর বলল, বাপ মায়ের কাছে এসে তোমার স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে।
ছাই হয়েছে।
তুই কী বুঝিস? অ্যাঁ তুই বুঝিস কী। কাজী সাহেব হাসতে হাসতে তিরস্কার করে উঠলেন মেয়েকে। বুঝলেন বাবর সাহেব, হোস্টেলে থেকে থেকে খাওয়া দাওয়াই ভুলে গেছে। মেয়েটা। এক টুকরোর বেশি দুটুকরো মাংস দিলে তেড়ে ওঠে এখন।
হ্যাঁ খাইয়ে খাইয়ে আমাকে একটা হাতি বানাও।
শুনছেন, কথা শুনছেন ওর। রাতদিন এই বলবে। আর না খেয়ে থাকবে। আচ্ছা বলুন তো কী এমন মোটা ও?
মোটেই না।
আপনাদের ও দুটো চোখ, না বোতাম? বলে লতিফা হাসতে হাসতে ট্রে নিয়ে চলে গেল। তার পেছনটা দুলে উঠল। নরোম একটা ছোট্ট শাদা জন্তুর মত। ময়মনসিংহে এসে স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে লতিফার। গাল দুটো লাল হয়েছে। শরীরে একটা তরঙ্গ এসেছে।
আপনার মেয়েটি চমৎকার। অসাধারণ বুদ্ধিমতি। মাথা অত্যন্ত পরিষ্কার। ওর সায়েন্স পড়া উচিত ছিল। ডাক্তার হতে পারত। কিন্তু অংকে বড্ড কাঁচা বলেই তো দিইনি।
অংকে কাঁচা নাকি?
ম্যাট্রিকে মাত্ৰ চল্লিশ পেয়েছিল। তাছাড়া কী জানেন, আমিও আগেই বুঝেছি লেখাপড়া বিশেষ ওর হবে না।
এটা আমি স্বীকার করলাম না।
কাজী সাহেব বলে চললেন, আমি ওকে শুধু ভাল হাউস-ওয়াইফ হতে যা দরকার তাই করে দিচ্ছি। যেন কোনো অবস্থাতেই অপ্রতিভ না হয়।
অবশ্যি এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গি; কিন্তু আমি সমর্থন করি না।
মৃদু হাসছিলেন কাজী সাহেব তখন থেকে। এবার হাসিটা আরো স্পষ্ট দেখােল! বোধহয় কিছু বলতে চান। বাবর উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল। তাঁর দিকে।
কই, সিগারেট খান।
কাজী সাহেব তার ব্ৰ্যাণ্ড বাড়িয়ে দিলেন।
আপনার ব্ৰ্যাণ্ড আনতে দিয়েছি।
কেন আবার কষ্ট করতে গেলেন?
না, না, কষ্ট কীসের। আপনি এসেছেন, কত যে খুশি হয়েছি। মনে মনে আপনার কথাই ভাবছিলাম কদিন থেকে। আপনি খুব ভাল সময়ে এসেছেন। খুব ভাল হয়েছে।
কী ভাল হয়েছে জানতে পারার আগেই কাজী-গৃহিণী এলেন। চট করে একটা ধোয়া শাড়ি পরে মাথার চুল গুছিয়ে গাছিয়ে এসেছেন।
উঠে দাঁড়াল বাবর।
আদাব ভাবী। ভাল আছেন।
জি ভাল। বসুন। ছেলেমেয়ে সব ভাল?
ভাল।
কাজী-গৃহিণী হাসলেন।
মিথ্যেটার জন্যে বাবর একটু অস্বস্তি বোধ করল। বিয়ে সে করেনি, এই কথাটা এদের আর জানাবার উপায় নেই।
আপনাকে টেলিভিশনে মাঝে মাঝে দেখি।
বিজ্ঞানের এই এক অবদান! নিজে না আসতে পারলেও কেমন দেখা হয়ে যাচ্ছে।
স্বামী স্ত্রী উভয়েই অনাবিল উপভোগ করলেন রসিকতটুকু।
আজ থেকে যেতে হবে কিন্তু।
কাজী ভাইকে তো বলেছি থাকব।
কাজী সাহেব ভাই সম্বোধনে খুব প্রীত হলেন, উৎসাহ পেলেন, কৃতাৰ্থ বোধ করলেন। বললেন, কয়েক দিন থাকলে সত্যি খুব খুশি হতাম।
আরেকবার এসে না হয় থাকব।
তখন তো বাড়ি খালি হয়ে যাবে। বিষণ্ণ স্বরে কথা কটি উচ্চারণ করলেন কাজী সাহেব।
বাবর ঠিক বুঝতে পারল না অর্থটা। জিজ্ঞেস করল, মানে?
লতিফার বিয়ে দিচ্ছি যে।
কানে শুনেও যেন কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারল না। বাবর।
বিয়ে দিচ্ছেন?
হ্যাঁ। একটা ভাল ছেলে পেয়ে গেলাম।
শুকনো গলায় বাবর জিজ্ঞেস করল, কবে?
দিন তারিখ ঠিক হয়নি। তবে খুব শিগগির। পাকা দেখা হয়ে গেছে।
ছেলে কী করে?
চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পড়তে বিলেতে যাচ্ছে এ বছরে। লতিফাকে নিয়ে যাবে।
বিলেত যাবার এতদিনের স্বপ্নটা তাহলে সত্যি হবে লতিফার— ভাবল বাবর। চুপ করে রইল সে।
কাজী গৃহিণী বললেন, পাত্র আমারই খালাতো বোনের ছেলে। লতিফাকে দেখে ওর খুব পছন্দ। আমি পড়ানোর পক্ষে। ছেলে বলল, বিয়ের পরেও তো পড়তে পারে। বিলেতে পড়াশুনা আরও ভাল হবে।
তা হবে।
মনটা যেন কোথায় এক চিলতে খারাপ লাগছে। কিন্তু কেন, বাবর তা বুঝতে পারল না। বাহ লতিফার কোনোদিন বিয়ে হবে না নাকি? সে নিজেই তো কতদিন লতিফাকে বিয়ের কথা বলেছে। বলেছে, বিয়ে হলে তার বাড়িতে যাবে। কী খেতে দেবে লতিফা? থাকবার জন্যে জোর করবে না? স্বামীর সঙ্গে কী বলে আলাপ করিয়ে দেবে তাকে?–আরো কত কী! আর, লতিফার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এদিকে, অথচ কিছুই সে জানে না। এ জন্যেই কি হঠাৎ ঢাকা থেকে সে চলে এসেছে কোনো খবর না রেখে? কই লতিফার সঙ্গে তার যখন শেষ দেখা হয়েছে তখন তো কিছুই বোঝা যায় নি। অথচ কতদিন বাবরকে বলেছে, কোনো কিছুই তার কাছে সে গোপন করে না।