বাবর বেরিয়ে এলো।
আজ বড্ড একা লাগছে তার। অনেকদিন এ রকম মনে হয়নি। মনে হচ্ছে, তার ভীষণ একটা কিছু হতে যাচ্ছে; সেটা ভাল না মন্দ তা বোঝা যাচ্ছে না।
করিডরের দরোজার কাছে প্রোগ্রাম ম্যানেজার সাহেবের সাথে দেখা। এই যে বাবার সাহেব।
কেমন, ভাল?
এসেছেন, ভালই হলো। আপনার সঙ্গে কথা আছে।
অপেক্ষা করি?
হ্যাঁ, আমার ঘরে গিয়ে বসুন। আমি দুমিনিটে আসছি।
বাবর তার ঘরে গিয়ে বসল। কমলা রংয়ের সরাসরি লাইন টেলিফোনটা জ্বলজ্বল করছে একরাশ কাগজপত্রের ভিড়ে। করবে নাকি একটা টেলিফোন বাবলিকে? বাবর সিগারেট ধরাল। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। বাবলির পিঠের তিলটা হঠাৎ চোখে ভেসে উঠল তার। আর সেই সঙ্গে অস্পষ্ট গুরু একটা সুগন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। অভিভূতের মত টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াল বাবর।
হ্যালো। কে?
অপর পক্ষের গলাটা এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল বাবলির। কিন্তু পরীক্ষণেই টের পেয়েছিল, না বাবলির ভাবী।
আমি বাবর বলছি। সেলিম কই?
এইতো এখানেই, দিচ্ছি।
সেলিম টেলিফোন ধরল।
কিরে? কোত্থেকে?
টেলিভিশন থেকে।
খুব গ্যাঁজাচ্ছিাস, না?
দূর। একটা কাজে এসেছিলাম। ভাবলম দেখি তুই বাসায় আছিস নাকি?
আসবি?
দেখি।
আয় না, অনেকদিন তোকে দেখি না।
কেন, টেলিভিশনে তো দেখিস।
বাবর একটু পরিহাস করবার চেষ্টা করল। তার উত্তরে সেলিম বলল, নে নে আর বাহাদুরি করতে হবে না। আসবি কি-না বল?
আচ্ছা, আসছি।
কতক্ষণে?
এই একটু পরেই। বলেই বাবর লোভ সামলাতে পারল না, বাবলির উল্লেখ করতে গিয়ে একটু দূর থেকে আরম্ভ করল, ভাল আছিস তো?
আছি।
তোর বৌ?
সেও ভাল।
বাবলির পড়াশুনা কেমন হচ্ছে?
কী জানি। পড়াশুনা করছে নিশ্চয়ই।
এই কি ভাইয়ের মত কথা? একটু খোঁজ খবর নিতে হয়।
সত্যি রে, একেবারে সময় পাই না। মনেও থাকে না ছাই।
বাবর হাসল। প্রোগ্রাম ম্যানেজার সাহেব ঘরে এসে ঢুকলেন।
সেলিম হাসল।
আচ্ছা, আমি আসছি।
আয়।
টেলিফোন রেখে বাবর একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল, বড় ব্যস্ত মনে হচ্ছে?
ব্যস্ত তো বটেই। একটা ইমপরট্যান্ট ইন্টারভিউ রেকর্ড হবে কাল। আমাদের নতুন সিরিজটার জন্যে।
ও। আমাকে কী বলবেন বলছিলেন।
বলছি, বলছি। চা?
খেতে পারি।
বেল টিপে চায়ের জন্যে ফরমাশ করলেন তিনি। তারপর কয়েকটা কাগজ এদিক থেকে ওদিকে সরিয়ে, অনাবশ্যকভাবে টেলিফোনের বইটা খুলে একবার দেখে, হঠাৎ বাবরের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার প্রোগ্রামটা বাবর সাহেব—
বাবর উদ্বিগ্ন চোখে তার দিকে তাকাল।
আপনার প্রোগ্রামটা কিছুদিনের জন্যে বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
কেন, খারাপ ছিল না তো সিরিজটা!
না, তা নয়, সিরিজটা খুবই ভাল, আপনি করেছেনও চমৎকার।
বাবর ঠিক বুঝতে পারল না লোকটা সত্যি সত্যি ভাল বলছে, না প্রোগ্রাম উঠিয়ে দেবে বলে তেতোর উপর মিঠে প্ৰলেপ লাগাচ্ছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল তার।
তিনি বললেন, আপনার পরিচালনা খুবই ভাল, কিন্তু আমরাই ঠিক করলাম কিছুদিনের জন্যে বন্ধ থাক।
কেন?
জানেন তো, টিভি প্রোগ্রাম যখন খুব ভাল হতে থাকে, তখনই বন্ধ করতে হয়। তাতে পরে আবার যখন সিরিজটা শুরু হয় তখন দর্শক উৎসাহ নিয়ে দেখে। এতে আপনারই লাভ।
তাতো বটেই।
বাবর চেষ্টা করেও প্ৰফুল্ল থাকতে পারল না। কেমন যেন বঞ্চিত মনে হতে লাগল। তার নিজেকে।
প্রোগ্রাম ম্যানেজার সাহেব চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, অনেক দিন তো করলেন, মাস তিনেক বিশ্রাম নিন। আবার শুরু করবেন। আরে, আপনারাই তো আছেন। আপনাদের ছাড়া আমরা কাদের নিয়ে স্টেশন চালাব? নিন, চা খান।
আজ যেন তাঁর কোনো কথাই বিশ্বাস করতে পারছে না বাবর। তার টিভি সিরিজ যে এভাবে শেষ হয়ে যাবে সে ভাবতেও পারেনি। তার ধারণা ছিল আরো অন্তত তিন মাস চলবে, আগামী মার্চ পর্যন্ত।
তাহলে এই সামনের দুটো প্রোগ্রামই শেষ প্রোগ্রাম?
হ্যাঁ। শেষ প্রোগ্রামটা একটু জমিয়ে করবেন। ফেয়ারওয়েল প্রোগ্রাম তো! নতুন কিছু করতে পারবেন না? নতুন ধরনের কোনো প্রেজেন্টেশন?
ভেবে দেখব। আচ্ছা উঠি, আমার আবার এক জায়গায় যেতে হবে।
বাবর উঠে দাঁড়াল। প্রোগ্রাম ম্যানেজার হাত বাড়িয়ে বললেন, আপনার অবশ্য একটু আর্থিক লোকসান হলো।
না, না ঠিক আছে। আমি তো টাকার জন্যে প্রোগ্রাম করি না।
সে জানি। আপনার অন্য মেলা সোর্স আছে ইনকামের। সেই জন্যেই সরাসরি বলতে পারলাম।
চলি।
আচ্ছা, দেখা হবে।
বিমূঢ়ের মত বাইরে এসে থমকে দাঁড়াল বাবর। দাঁড়িয়ে থাকল। কিছুক্ষণ। ও কথা সে সত্যি বলেছে, প্রোগ্রাম টাকার জন্যে করে না। প্রোগ্রাম তার কাছে নেশার মত অনেকটা। এই যে যখন সে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াচ্ছে এক সঙ্গে এত হাজার হাজার লোক তাকে দেখছে, এর একটা প্ৰচণ্ড আকর্ষণ আছে। টাকা দিয়ে তার পরিমাপ করা যায় না।
টাকা তো সে ইনডেন্টিং থেকে কম রোজগার করে না। কিন্তু সেখানে এই যাদু, এই সম্মোহন নেই।
তাছাড়া, তাছাড়া এই প্রোগ্রামের জন্যেই তো সে প্রথম জানতে পেরেছিল লতিফাকে।
ঝড়ের মত বেরিয়ে গেল বাবর। বেরিয়ে গাড়িতে বসল। প্ৰচণ্ড শব্দ তুলে স্টার্ট করল ইঞ্জিন। আপন মনেই বলল, খেলারাম খেলে যা। তারপর রওয়ানা হলো বাবলিদের বাড়ির দিকে।
০৬. বাবলি
পর্দা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখল, সেলিমের সামনে বাবলি একগাদা বইপত্র নিয়ে মুখ কালো করে বসে আছে। বাবরকে দেখে দ্রুত চোখ নামিয়ে নিল বাবলি। এলোপাতাড়ি একটা বই ওল্টাতে লাগল।