আজ কতটা হুইঙ্কি খেয়েছেন বলুন তো!
আপনি তো খান না, কাজেই শুনে আন্দাজ করতে পারবেন কি?
আন্দাজ না করতে পারলেও শুনতে ক্ষতি কী?
ও, তা বটে।
এই যে সেদিন চাঁদে মানুষ নামল, কত কী রিপোর্ট বেরুল, সবটা কী বুঝতে পেরেছি? না কেউ পেরেছে? তবু মানুষ শোনার জন্যে রাত জেগে রেডিও-র পাশে বসে থাকেনি?
থেকেছে। থেকে তারা এটুকুই শুনেছে মানুষ চাঁদে নেমেছে। আপনিও তো শুনেছেন, আবার না হয় শুনুন, আমি আজ মধ্যপান করেছি।
কথায় আপনার সঙ্গে কে পারে?
বাবর হাসল।
মিসেস নফিসের তখন রাগ হলো আরো বেশি। তিনি বললেন, কথা বলে আপনি পয়সা পান। খামখা এত ভাল ভাল কথা বিনি। পয়সায় ছাড়ছেন কেন?
এটা টিভি স্টুডিও নয়।
যাক, বাঁচা গেল। আমি তো ভাবছিলাম। আপনি এটা টিভি স্টুডিও মনে করে বসে আছেন।
হা হা করে হেসে উঠল বাবর।
হাসলেন যে!
এমনি।
না, বলতে হবে কেন হাসলেন। হাসি সব সময় মানসিক কারণে হয় না। কখনো কখনো শুদ্ধ শারীরিক কারণে, পেশি নার্ভ ইত্যাদির অকারণ সহসা কোনো নতুন সংস্থাপনেও হাসি পায়। আপনি এরপর টিভিতে শরীরটাকে ভাল রাখুন। প্রোগ্রামও করবেন নাকি?
করতে পারি। অন্তত আমার কোনো আপত্তি নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি ঐ ডাক্তারদের চেয়ে অনেক সরস করে বলতে পারব।
এখান থেকে ফিরে গিয়ে আবার হুইস্কি খাবেন?
বলতে পারি না। আপনার তো সব কিছুই আগে থেকে হিসেব করা থাকে। কেন বলতে পারবেন না? বলতে
সংকোচ হচ্ছে?
সংকোচ শব্দটা আমার অজানা।
আর কোন কোন শব্দ আপনার অজানা শুনি?
আরো অনেক আছে। যেমন, শোক, বিবাহ, ভালবাসা।
কাউকে কখনো ভালবেসেছেন?
হ্যাঁ বেসেছি।
বেসেছেন?
হ্যাঁ।
নাম বলতে আপত্তি আছে?
না, নেই।
কে সে?
আমি নিজে।
বাবর রসিকতা করল কি-না বুঝতে পারলেন না মিসেস নাফিস। তিনি অনির্দিষ্ট চোখে তাকিয়ে রইলেন প্রথমে বাবরের মুখে, তারপর তার হাতের দিকে, যে হাত দুটো ম্যাচের শূন্য খোল নিয়ে খেলা করছিল।
বাবর জিগ্যেস করল, নাফিস সাহেব কোথায়?
বললাম না হাসপাতালে?
সত্যি আমি দুঃখিত। ভুলে যাচ্ছি।
আমার কী মনে হয় জানেন, নফিসকে আপনি ঠিক পছন্দ করেন না।
কেন?
অবশ্যি আমিও ওকে ঠিক পছন্দ করি না, করতে পারি না, এই তের বছরেও ঠিক পেরে উঠিনি।
তের বছর বিয়ে হয়েছে আপনাদের?
হ্যাঁ, উনিশ শো ছাপ্পান্নতে বিয়ে হয়েছিল। তেরাই তো হলো। হ্যাঁ তের হলো। বিয়ে ঢাকাতেই হয়েছিল?
ঢাকাতেই।
আচ্ছা, আমি এখন চলি।
সে-কী, এখুনি যাবেন?
কাজ আছে।
তবে যে বললেন আজ আর কাজ নেই।
বলেছিলাম নাকি?
ভেবে দেখুন।
বোধহয় বলিনি। কিংবা বলেছি। চলি।
বাবর উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়ালেন মিসেস নাফিসও। কী ভেবে বাবর আবার বসল। বলল, না হয় এক পেয়ালা চা দিন। চা খেয়েই যাই।
খারেন?
না, না, চা খেলে নেশা নষ্ট হবে না।
মিসেস নাফিস উঠে গেলেন চা করতে। আর বাবর বসে বসে ভাবতে লাগল বাবলির কথা। কাজী সাহেবকে সে বলেছিল, তার মেয়ে আছে, মেয়ের নাম বাবলি বাবর। চাঁদের মত একটা হাসি তার ঠোঁটে জন্ম নিল। বাবলিকে কাল আবার আসতে বলতে হবে। এখান থেকে বেরিয়ে বাবলিকে একবার দেখতে গেলে হয়। যাবে সে।
চা নিয়ে এলেন মিসেস নাফিস।
এমন সুন্দর চায়ের জন্য ধন্যবাদ।
এই চা পাঠিয়েছিল শ্ৰীমঙ্গল থেকে ওর এক বন্ধু। একেবারে বাগানের। ভারি সুন্দর ভ্ৰাণ। আরেক কাপ দিই?
না।চলি। আবার আসব।
বাবর মিসেস নাফিসকে একা ফেলে বেরিয়ে গেল দ্রুতপায়ে গাড়ির চাবিটা বানাৎ ঝনাৎ করে বাজাতে বাজাতে। শব্দটা আগুন ধরিয়ে দিল মিসেস নফিসের সারা দেহে। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে একবার উচ্চারণ করলেন, রাস্কেল। তারপর তার কান্না পেল। তিনি মানসিকভাবে কাঁদলেন।
বাইরে বাবরের গাড়িটা অট্টহাস্যের মত কয়েকটা শব্দ তরঙ্গ তুলে অনেক ধ্বনির মধ্যে মিলিয়ে গেল।
০৫. উদ্দেশ্যবিহীন কিছুক্ষণ
গাড়ি নিয়ে উদ্দেশ্যবিহীন কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াল সে। একবার মনে হলো তার ক্ষিদে পেয়েছে, কিছু খাওয়া দরকার। কিন্তু উৎসাহ পেল না। কোন হোটেলে বসবে, অর্ডার দেবে, অপেক্ষা করবে, খাবার আসবে–বড় দীর্ঘ মনে হলো ব্যাপারটা। ইন্টারকন্টিনেন্টালের মোড়ে একটা লোক রঙ্গীন তুলোয় তৈরি সিংহ বিক্রি করছে।
কত দাম?
আপনার জন্যে দশ টাকা।
একবার ভাবল, কেনে। আবার ভাবল, কিনে কী হবে? ট্রাফিকের নীল বাতি জ্বলে উঠল। বাবর বেরিয়ে গেল।
কোথায় যাবে সে? বাবলিকে কাল একবার আসতে বলা দরকার। কিন্তু এখুনি ওদের বাসায় যাওয়াটা খুব সমর্থনযোগ্য বলে মনে হলো না।
ঢাকা ক্লাবের সামনে ভেতরে অসংখ্য গাড়ি। মিষ্টি একটা বাজনার শব্দ শোনা যাচ্ছে। গতি শ্লথ করল বাবর। বড্ড একা লাগছে। কোথাও কাউকে পেলে হতো। অনেকদিন এমন একা মনে হয়নি।
কেন একা লাগছে?
বয়স হয়ে যাচ্ছে তার?
না, তাও তো নয়।
নিজের সঙ্গেই কথা বলে বাবর। মনে মনে। আবার আপন মনেই হাসে। এইতো এখনো একেবারে কালকের কথা মনে হয়, সে ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে বই বগলে ইস্কুলে যাচ্ছে। মহিতোষ বলে এক দুর্দান্ত ছেলে ছিল, দুক্লাশ ওপরে পড়ত। তার পেছনে কী লাগাটাই না লেগেছিল মহিতোষ। খারাপ খারাপ কথা বলত। ইস্কুলের পেছনে ভাঙ্গা পায়খানায় নিয়ে প্যান্ট খুলতে চাইতো তার।
ছেলেবেলায় দেখতে বোধ হয় আমি গোলগাল সুন্দর ছিলাম, ভাবল বাবর। নিজের অজান্তেই এক হাতে নিজের চিবুক নিয়ে খেলা করতে লাগল সে। তোপখানার মোড়ে আবার লাল বাতি। আর একটু হলেই সামনের গাড়িতে ধাক্কা লাগত। গাড়ির ট্যাক্স দেবার সময় হয়ে এসেছে। কাল মনে করতে হবে। আবার সেই ভাঙ্গা পায়খানার ছবি ভেসে উঠল তার চোখে। মনে পড়ল ছেলেবেলায় সেই ভাঙ্গা পায়খানায় গেলেই কেমন গা শিরশির ছমছম করে উঠত। দেয়ালের লেখাগুলোও স্পষ্ট দেখতে পায় সে।