এ-কী জিগ্যেস করছেন?
বলুন না।
যদি বলি খেয়েছি।
যদি বলি কেন? খেয়েছেন তো খেয়েছেন! এখনো খান?
কী করে বুঝলেন?
হঠাৎ মনে হলো।
আপনি মানুষের মন পড়তে পারেন?
পারি না। পারলে দাবি করা হতো মন পড়ার বিজ্ঞান আছে। আসলে কিন্তু নেই। মনের কোনো হিসেব হয় না। মন মনের মত চলে। নাফিস সাহেব কোথায়?
হাসপাতালে।
প্রায় লাফ দিয়ে উঠল বাবর। বলল, কই আমাকে আগে বলেননি তো। কী হয়েছে তার? কবে থেকে?
তার কিছু হয়নি। তার মামার আজ অপারেশন। চোখের।
ও, তাই বলুন।
ফিরতে রাত হবে।
বাবর তার দিকে চোখ গভীরতর করল। ঘন সবুজ শাড়ি পরেছেন মিসেস নাফিস। একই রংয়ের ব্লাউজ। কপালে সবুজ টিপ। পায়ের স্প্যান্ডেলে সবুজ ফিতে। হাসছেন যখন, মনে হচ্ছে দাঁতেও সবুজের একটু আভা দিচ্ছে।
তাকিয়ে আছেন যে।
না, একটা সিগারেট খাবেন?
থাক, ইচ্ছে করছে না।
আচ্ছা, আপনি মদ খেয়েছেন কখনো?
মদ?
হ্যাঁ মদ। লিকার।
না, খাইনি।
খাবেন একদিন?
নিমন্ত্রণ না পরামর্শ?
খানিকটা নিমন্ত্রণ তবে অনেকটা পরামর্শ।
হঠাৎ এ পরামর্শ দিচ্ছেন?
তাহলে ভাল হতো।
কী ভাল হতো।
মনে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য পেতেন।
আপনি বুঝি তাই খান।
হ্যাঁ, তার জন্যেই খাই। কিন্তু উদ্দেশ্যটা শেষ পর্যন্ত গুলিয়ে যায়। মাতাল হয়ে পড়ি। ঘুম পায়। পরদিন মাথা ধরে। তখন মনে হয় অসুস্থ হবার জন্যেই খেয়েছিলাম।
তাহলে খান কেন?
খাই কেন? শরীরটা বেয়াড়া রকমে সুস্থ। মাঝে মাঝে অসুস্থ হওয়া, এভাবে হওয়া, মন্দ কী? অসুস্থ হলে সুস্থতা কী, তা ভাল বোঝা যায়।
অর্থাৎ আপনি ভালকে জানতে মন্দের আশ্রয় নেন।
হ্যাঁ, নিই।
আপনি পাপ করতে পারেন?
পারি। পাপীই জানে পুণ্য কী!
সব পাপী তো জানে না। জানে না। কারণ পাপী দুরকমের। শুধু পাপী আর জ্ঞান-পাপী। আপনি তাহলে জ্ঞান-পাপী।
হ্যাঁ, তাই।
আপনি এখন মদ খেয়ে আসেননি তো? না। হ্যাঁ, খেয়েছি বলতে পারেন।
সেটা কী রকম?
ধরে নিন খেয়েছি। বাবর মনে মনে ভাবল, মিসেস নাফিস কী জানবেন, এই কিছুক্ষণ আগে সে কোন নেশা
করে এসেছে? বাবলি যতক্ষণ ছিল বুঝতে পারেনি। চলে যাবার পর বাবরের মনে হচ্ছিল সে যেন কয়েক পেগ কাঁচা হুইঙ্কি গিলেছে।
মিসেস নাফিস বললেন, আমি ঠিকই ধরেছি, এই বিকেল বেলায় আপনি হুইস্কি গিলে এসেছেন। কেন ওসব খান?
শরৎচন্দ্রের পরামর্শে খাই না। নিজেকে ডাইলান টমাস মনে করেও খাই না। ডাইলান টমাস কে?
কবি।
আপনি কবিতা লেখেন না কেন?
এটা প্রশ্ন হলো না। আমি কেন তাহলে রাজনীতি করি না, কেন আমি গান গাই না, কেন আমি বিয়ে করি না–
সত্যি, কেন বিয়ে করেন না?
সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বাবর জের টেনে চলল, কেন আমি সাংবাদিকতা করি না, এ রকম পৃথিবীর এক লক্ষ একটা কাজ কেন করি না–এর কোনো জবাব নেই।
মিসেস নফিসের একবার মনে হলো, লোকটা বড় রূঢ়। তিনি আনমনা হলেন। বাবর জিগ্যেস করল, আপনার বড় ছেলে কই? কী যেন নাম?
হাসু। সাইকেল চড়া শিখতে গেছে। আপনার টিভি প্রোগ্রামের খুব ভক্ত।
আমি জানি।
আচ্ছা, সেদিন যে ধাঁধাটা দিলেন তার উত্তরটা কী?
কোন ধাঁধা?
ঐ যে বললেন, এক মহিলা, দুটো ট্রাঙ্ক, একটা বেড়িং, কয়েকটা হাঁড়ি, একটা মাটির উনোন আর কী কী নিয়ে, কোলে একটা বাচ্চা, হাসিমুখে ট্রেনে চড়ছে। সে বাপের বাড়ি থেকে আসছে না যাচ্ছে? বলুন না, কী উত্তর হবে?
সামনের সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তখন আমিই টিভিতে বলে দেব।
বারে, তাহেল আপনার সঙ্গে আলাপ থেকে লাভ?
আমার সঙ্গে শুধু ধাঁধার উত্তর জানা পর্যন্তই সম্পর্ক?
না, তা নয়। কী যে বলেন। তা কেন হবে?
তাছাড়া এখন উত্তর বলে দিলে নিয়ম ভঙ্গ করা হবে। নীতি বলে একটা কথা আছে তো? কত লোক উত্তর পাঠাবে, সঠিক উত্তরগুলো থেকে লটারি করে পুরস্কার দেওয়া হবে। এখন উত্তর বলে দিলে আমার নিজের কাছেই খারাপ লাগবে।
আপনি উত্তর বললে তো আর আমি টিভিতে পাঠাতে যাচ্ছি না। আর পাঠালেও আমার নাম লটারিতে কোনোদিনই উঠবে না।
কী করে বলছেন?
আমি জানি। আমার ভাগ্যে হঠাৎ কিছু পাওয়া নেই।
বাবর তার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখল। পরে বলেল, এ কথা কেন বলছেন?
এমনি বলছি। কিছু না। আপনাকে চা দিই। কতক্ষণ এসেছেন।
চা থাক।
ও ভুলেই গিয়েছিলাম। আপনি ড্রিংক করে এসেছেন।
বাবর তার ভুল ভাঙ্গাবার উৎসাহ পেল না। বরং পা দুটো সামনে লম্বা করে দিয়ে আয়েশ করে বসে মিসেস নফিসের অনুমানের অভিনয় করে যেতে লাগল।
মিসেস নাফিস হঠাৎ নিঃশব্দে হাসলেন। অনেক সময় অনেকে এটা আমন্ত্রণ হিসেবে ব্যবহার করেন; অর্থাৎ আমাকে প্রশ্ন কর আমি কেন হাসছি। বাবর সে আমন্ত্রণ গ্ৰহণ করল না। তার সমস্ত মন এবং চোখ আচ্ছন্ন করে আছে। বাবলির শ্যামল ছিপছিপে দেহ। যা কিছুর ঘ্ৰাণ নিচ্ছে তার অন্তঃস্থল থেকে বাবলির ঘ্রাণ পাচ্ছে।
মিসেস নাফিস বললেন, চুপ হয়ে গেলেন যে!
এমনি। আপনার বসবার ঘরটা ভাল। সুন্দর।
ধন্যবাদ।
নাফিস সাহেব কোথায়?
বললাম না হাসপাতালে?
ও ভুলে গিয়েছিলাম।
আচ্ছা আপনি তো টিভিতে কাজ করেন, ওদের বলতে পারেন না প্রোগ্রামগুলো একটু ভাল করতে?
পারি না।
কেন?
আচ্ছা ওখানে কাজ করি না। ওদের চাকরি করি না। ওরা কী প্রোগ্রাম করবে না করবে: সেটা আমাকে জিগ্যেস করে না।
বাহ, সবাই তো আপনার বন্ধু। ওদের না হয় বন্ধু হিসেবেই পরামর্শ দিলেন।
আমার কী মনে হয় জানেন?
কী?
বন্ধুত্ব এ যুগের সবচে বিরল বস্তু। বন্ধুত্ব নেই বলেই যত্রতত্র আমরা বন্ধু শব্দটা ব্যবহার করে থাকি।