আপনি এখনো ঠাট্টা করছেন?
মোটেই না।
জানেন, আমি এই এপ্রিলে উনিশে পড়ব?
জানতাম না, জানলাম। তাতে চকোলেট খাবার বয়স চলে যায়নি। বরং চকোলেট টকোলেট খেলে একটু মোটা হবে। দেখতে ভাল হবে।
দেখতে আমি এমন কী খারাপ শুনি? আপনি যে লতিফার প্রশংসায় একেবারে গলে যান, তার চেহারা তো আমার চেয়েও বাজে। আর যা ধুমসি!
ভালুকের মত।
মুখে বলছেন। কিন্তু মন থেকে স্বীকার করেন না।
বাবর এ কথার কোনো জবাব না দিয়ে চকোলেট এনে বাবলির কোলে ফেলে দিল। বলল, খাও। সব তোমার। এবার শুনি কী বিপদ?
বিশটা টাকা হবে? বাবলি ডান হাত তুলে আঙুলগুলো নাচাল, যেন নিজের দিকে সে কয়েকটা অদৃশ্য সুতো টেনে নিল তাঁতিদের মত।
বিশ টাকা! সে তো মেলা টাকা।
হবে কি-না বলুন।
হবে। দিন। চটপট দিন। আবার সামনের মাসে ভাইয়ার কাছ থেকে হাত খরচা পেলেই শোধ করে দেব।
ভাল কথা, তোমার ভাইয়া কোথায়?
কেন, অফিসে?
তাকে বল ফারুক এসেছে ঢাকায়।
ফারুক কে?
ও তুমি চিনবে না। আমরা ছেলেবেলা থেকে এক সঙ্গে পড়াশোনা করেছি। তোমার ভাইয়া হতো ফাস্ট, ফারুক সেকেন্ড আর আমি বরাবর–
তাকে বাধা দিয়ে বাবলি অসহিষ্ণু কষ্ঠে বলে উঠল, টাকাটা পাব?
পাবে, পাবে।
আসলে বাবর চাইছিল বাবলি যেন চলে না যায়। ঐ যে তার মনে হচ্ছিল, আজকেই হয়ত সেই প্রথম দিন বাবলির সাথে, সেই সম্ভাবনাটা তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। কিন্তু এটাও সে জানে এই মেয়েরা যৌবনে পা দিলেও, মনে মনে এখনো কিশোরী। তাদের কথা চটপট শোনা শেষ পর্যন্ত ভাল ফল দেয়।
বাবর টাকাটা বের করে দিল। খটাস করে ভ্যানিটি ব্যাগ বন্ধ হয়ে গেল। পায়ে স্যান্ডেলজোড়া ফের উঠে এলো। বাবলি বলল, ধন্যবাদ, যাই।
যাবে তো। যাবে তো বটেই। চকোলেটগুলো শেষ করে যাও।
পথে খাব। যেতে যেতে খাব।
ওটি হবে না। এখানে সব খেতে হবে।
কেন?
খেয়ে এক গ্ৰাস পানি খাবে। তারপর যাবে। নইলে দাঁতে পোকা লাগবে।
বাব্বা। আপনার সঙ্গে পারি না।
বাবলি আবার বসল। চিবোতে লাগল চকোলেট। দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে খয়েরি রং লাগল। তখন যেন তাকে আরো সুন্দর দেখাল। বাবলিকে এখনই যেতে দেয়া যায় না, বাবর ভাবল। কিন্তু কী করে? বাবর জিজ্ঞেস করল, টাকাটা কী হবে?
বলব না। সিক্রেট।
বল।
না।
বল।
বললাম তো, সিক্রেট।
এত সিক্রেট রাখতে নেই। এক আধজনকে বলতে হয়। তাতে সিক্রেট আরো জমে ভাল।
দূর।
বাবলি চকোলেট চিবোতে চিবোতে পা নাচাতে নাচাতে বলল।
তা হলে আমি রাগ করলাম।
বাবলি এবার আড়চোখে বাবরকে দেখল। তারপর খিলখিল করে হেসে উঠল। হঠাৎ বলল, বলছি, বলছি। এমন কিছু সিক্রেট না। সেদিন কলেজ থেকে চায়নিজ রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম। আমরা চারজন।
ছেলে না মেয়ে?
মেয়ে সাহেব, মেয়ে। ছেলেদের সঙ্গে আমি মোটেই বেরোই না। আমি ওদের হেট করি।
আমাকেও?
আপনি কী ছেলে?
তার মানে?
আপনি তো কত বড়? ভাইয়ার বন্ধু।
ও তাতো বটে, তারপর?
ভাইয়ার বন্ধু শুনে বাবর যেন একটু থেমে গেল। কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য।
তারপর সবাই মিলে তো রাক্ষসের মত খেয়েছি। সবাই ভেবেছি সবার কাছেই টাকা আছে এক আমার কাছে ছাড়া। বিল দিতে গিয়ে মাথায় বাজ। পুরো সাতাশ টাকা বার আনা–আর সবার কাছে সব মিলিয়ে এগার টাকা সাতষট্টি পয়সা।
মাথা খারাপ! ঐ ভাবে খেতে যায়?
মজা শুনুন না। সবার মুখ তো শুকিয়ে এতটুকু। পাশে এক বুড়ো বসে খাচ্ছিল। বণি বলল, ওর কাছে চল ধার করি।
বণি কে?
আপনি চিনবেন না।
চিনিয়ে দিয়েছ নাকি যে চিনব?
আচ্ছা, একদিন নিয়ে আসব। তারপর বুড়োর দিকে আমরা চারজন এক সঙ্গে তোকালাম। বুড়ো হঠাৎ চোখ তুলে দেখে ড্যাবডোবে আটটা চোখ। সে বেচারা স্বপ্নেও ভাবেনি এ রকম করে আমরা তাকিয়ে থাকব। কেন? তাই দেখে তার গলার কাছে ঝুলঝুলে চামড়াটা থর থর করে কাঁপতে লাগল। আর আমাদের হাসি পেয়ে গেল।
সত্যি?
আমরা এক সঙ্গে হেসে উঠতেই বুড়ো আর পালাবার পথ পায় না। একবার এক চেয়ারের সঙ্গে, আরেক বার টেবিলের সঙ্গে–ধাক্কা! হাসতে হাসতে পেটের সব হজম।
খুব অন্যায়। বুড়োটার খাওয়া মাটি করে দিলে।
বারে, আমাদের কী দোষ। আমরা শুধু তাকিয়েছি–তার গলার চামড়া ওরকম নড়তে শুরু করল কেন?
তারপর বেরুলে কী করে?
বেয়ারাকে তিন টাকা বকশিস দিলাম। কাউন্টারে চীনে ব্যাটা বিমোচ্ছিল। তাকে আট টাকা দিয়ে বললাম, কুড়ি টাকা কাল দিয়ে যাব। বলে চারজন লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে এলাম। চীনেটা কিছু বলল না?
বলবে কী? তার বলবার আগেই আমরা দরোজার বাইরে।
ছি ছি ছি।
কী ছি ছি? আমরা তো টাকা মেরে দিচ্ছি না? এক্ষুণি যাবার পথে এই কুড়ি টাকা তার মুখের ওপর ফেলে দিয়ে আসব।
আমাকে একটা টেলিফোন করলেই তো হতো।
তা হতো। আপনার কথা মনেই হয়নি।
তা হবে কেন? আমার কথা তো মনে হবে না। বলে বাবর লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। শুয়ে চোখ বুজল। ভান করল যেন মনে খুব লেগেছে তার কথা মনে হয়নি বলে। হঠাৎ সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল। বাবলি তার পায়ের বুড়ো আঙুল ধরে টানছে।
এই যে, কী হলো?–শুনুন।–আচ্ছ। এরপর কখনো এ রকম হলে নিশ্চয় ফোন করব। — কই, শুনুন।
চোখ মেলে মিষ্টি করে হাসল বাবর। নিঃশব্দে। তারপর বাবলির একটা হাত নিয়ে খেলা করতে করতে বলল, তুমি মনে করেছ, আমি রাগ করেছি, না? পাগল মেয়ে, আমার কি সে বয়স আছে?–একেক সময় কী ভাবি জান?
কী?
বাবর লক্ষ করল বাবলির গলা অত্যন্ত সূক্ষ্ম তারে যেন কেঁপে উঠল। এতে সে খুশিই হলো মনে মনে। বলল, ভাবি, আমার বয়স দশ বছর কম হলো না কেন? কিংবা তুমিও তো আরো দশ বছর আগে হলে পারতে।