নিশ্চয় আছে। আমি, টেলিফোনে হাত দেখা যাচ্ছে না, তবু আপনাকে কল্পনা করতে বলছি, আমি এই করজোড়ে আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।
রিনটিনটিন হেসে উঠলেন মিসেস নাফিস। বললেন, নাহ, কথায় আপনার সঙ্গে পারবার জো নেই। টেলিভিশনে কাজ করেন তো! কথা খুব বলতে পারেন।
বাবর বলল, শুধু কথা নয়, কাজেও।
তাহলে আজ প্ৰমাণ দিন। নইলে বিশ্বাস করব না।
আচ্ছা, আজই আসব। আসলে আমি ভাবছিলামও আজ। আপনার বাসায় যাব। তাহলে আজ। যাচ্ছি। কেমন? রাখি।
অবলীলাক্রমে মিথ্যে বলতে পারে বাবর। সেটা সে নিজেও জানে তবু প্রতিবারই একটা মসৃণ মিথ্যে বলে নিজেই চমৎকৃত হয় সে। যেমন এখন হলো।
বাথরুমে যাচ্ছিল বাবর, আবার টেলিফোন বেজে উঠল।
আমি মিসেস নাফিস বলছি। কখন আসবেন বললেন না তো?
ও, বলিনি? চারটে?
সাড়ে চারটে।
ঠিক, সাড়ে চারটেই আসব। রাখি?
আচ্ছা।
বাথরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে প্রস্রাব করল বাবর। এখনও রংটা গাঢ় হলুদ। কাল থেকে এই রকম। একটা অ্যালক্যালি মিকচার আনা দরকার। বেরিয়ে এসে গুমুধটা এনে কয়েক চামচ খেল সে। কেমন টকটক ঝাঁঝাল। কিন্তু বেশ লাগল খেতে। তারপর শাওয়ার খুলে গোসল করে লম্বা হয়ে পড়ল বাবর। ঘুম এলো সঙ্গে সঙ্গে। ঘুমের ভেতরে সে দেখল তার দরোজায় দাঁড়িয়ে আছে লতিফা। তার পরনে একটা সুতো পর্যন্ত নেই। কিন্তু একটুও অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। চোখে পুরু কাজল। কাজল গলে অশ্রুর ধারা নামছে।
আরে তুমি, দেখি, দেখি কী হয়েছে?
তাকে আদর করতে করতে ঘরে নিয়ে এলো বাবর। আর ভেতরে দেখল তারই বিছানায় এক হাঁটু পিরামিডের মত তুলে শুয়ে আছেন মিসেস নাফিস। তার ঠোঁটে স্থির একটা হাসির বিদ্যুৎ। বাবরের এ রকম মনে হলো লতিফা যেন মিসেস নফিসের মেয়ে। সে খুবই লজ্জিত এবং অপ্ৰস্তুত হলো। পরীক্ষণে সারা শরীর হিম হয়ে গেল তার। পা কাঁপতে লাগল। পালাবার জন্যে দৌড়ে বাথরুমের দিবোজাটা খুলতেই শাওয়ারের তীব্র ছটা এসে তাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল।
ধরমর করে উঠে বসল বাবর। সম্মুখে তাকিয়ে দেখল বাবলি দাঁড়িয়ে আছে। নিজের চেহারায় হাত রেখে টের পেল সেখানে পানি। জিগ্যেস করল, মানে?
এত ঘুম আপনার?
কখন এলে?
এইমাত্র। নাম ধরে ডেকেছি। পায়ে শুড়াশুড়ি দিয়েছি। শেষে মুখে পানি ছিটাতে হলো। এ সময় কেউ ঘুমায়?
শরীরটা ভাল নেই।
বলে বাবর আবার শুয়ে পড়ল। ভেবেছিল বাবলি এসে পাশে বসবে। তারপর–তারপর আজকেই হয়ত প্ৰথম সেই সময় আসবে; বাবলি যখন ফিরে যাবে তখন অন্য মানুষ। কত দীর্ঘ দিন সে এর জন্যে অপেক্ষা করে আছে। একটু একটু করে এগুচ্ছে বাবলির অন্তরঙ্গতার দিকে।
কিন্তু বাবলি তার পাশে তো বসলই না, তার শরীর খারাপ বলে কোনো উদ্বেগও দেখাল না। তার বদলে সরাসরি বলল, এখন একটা ব্যবস্থা করুন।
আচ্ছা, একে কী বলে?
বাবর বাবলির কালো পাজামার দিকে আঙুল তুলে জিগ্যেস করল।
কেন, পাজামা?
আহা, একটা নাম আছে তো?
বেল বটম। — আমার কথাটা শুনুন না?
শুনছি। তোমার সব কথা শুনব। তার আগে একটা কথা বল। বাবর উঠে বসে কোলে একটা বালিশ জড়িয়ে বলে চলে, বেল বটম বলতে তোমাদের একটু কেমন, লজ্জা করে না।? বেল বটম পাজামা?
কেন? ওমা সে-কী!
অবাক হয়ে বাবলি একটা মোড়ার ওপর ধাপ করে বসে পড়ল।
লজ্জা করবে কেন?
মিটমিট করে হাসতে লাগল বাবর।
বলুন না, কী?
তুমি ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ছ না?
হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে? আমি তো এখন বাংলা শিখছি।
আহা সে কথা নয়। সে তো আমি জানিই। তুমি এখন কী সুন্দর অ আ ক খ পড়তে পার। যাহ, আপনি ঠাট্টা করছেন। কী বলবেন তাই বলুন আর নইলে আমার কথা শুনুন। খুব বিপদে পড়েছি।
বিপদ?
বাবর ভাল করে বাবলির দিকে তাকাল। ঘাড় পর্যন্ত ছাটা চুল। মাথায় অসংখ্য চুলের চাঁদ এলাপাতাড়ি হয়ে আছে। শ্যামল লম্বাটে মুখটায় গালের ওপর উঁচু হাড়, অনেকটা বিদেশিনীদের মত। চিবুকটা পেস্ট্রীর প্রস্থের মত সরল ও চওড়া। চোখ সব সময় নাচ করছে যেন এইমাত্র মুখ ছেড়ে পালিয়ে যাবে। বিজ্ঞাপনের মত ঝকঝকে একসারি সুন্দর দাঁত সারাক্ষণ একটি হাসিকে ফ্রেম করে রেখেছে। এখানে কৈ, বিপদ তো কিছু বোঝা যাচ্ছে না?
বাবর আবার জিগ্যেস করল, বিপদ? কোথাও প্রেম ট্রেম করছ নাকি?
যাহ!
বাবর বুঝতে পারে না, প্রেমের উল্লেখমাত্রে মেয়েরা এমন লজ্জিত, অপ্ৰতিভ হয়ে যায় কেন? তার আরো আশ্চর্য লাগে, সে দেখেছে, মেয়েরা যখন প্ৰথম নগ্ন হয়, যখন প্রথম তাদের সেই অভিজ্ঞতা হয়, পুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, তখন তাদের যে লজ্জা তা এর চেয়ে অনেক কম। তখন লজ্জার বদলে তাকে শংকা, থাকে শিহরণ, থাকে মিনতি, থাকে সম্মোহন। কিন্তু লজ্জা? না। লতিফার কথা মনে পড়ে। প্রথম দিন, সেটা ছিল বিকেল, লতিফাকে এতটুকু লজ্জিত হতে সে দেখেনি। লতিফা ছিল চোখ বুজে। তার ঠোঁট জোড়া শাদা হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত শরীরকে পাথর করে একটা হাত দুই ঊরুর মাঝখানে শক্ত করে চেপে লতিফা বিছানায় আড়াআড়ি পড়েছিল একটি আয়তক্ষেত্রের নিখুঁত কর্ণের মত।
বাবর বলল, প্রেম নয়, তবে?
কী যে বলেন!
কার সঙ্গে কিছু হয়েছে?
আর কী হবে?
মানে, ডাক্তার দেখাতে হবে নাকি?
আমি চললাম। বাবলি উঠে দাঁড়াল। বাবর তাকে আটকে বলল, যাওয়া অত সোজা নাকি? বসো। লক্ষ্মী মেয়ের মত চুপ করে এখানে বসো। বলে তাকে প্রায় শূন্যে তুলে খাটের কোণায় বসিয়ে দিল বাবর। জিগ্যেস করল, চকোলেট খাবে? বিলেত থেকে এক বন্ধু দিয়েছে।