বড় দারোগা। দাঁ
ত মুখ খিঁচিয়ে উঠলেন সুরেন স্যার। দারোগার ছেলে, ঘোড়ার মত স্বাস্থ্য হবে এরকম লাউডগাটি হয়েছেন কেন? লেখাপড়ায় কেমন?
কী বলবে আনু। চোখ তুলে স্যারকে একবার দেখে আবার মাথা নিচু করে থাকে। সুরেন স্যার হঠাৎ জিগ্যেস করেন, আচ্ছা শুনি, বিশুদ্ধ জল কেমন?
বিশুদ্ধ জল? ঢোঁক গেলে আনু।
আজ্ঞে হাঁ। বলুন।
আনু ভারী অস্বস্তিবোধ করতে থাকে তাকে এই ঠাট্টা করে আপনি বলায়। কেন যেন রাগ হয় তার। উত্তরটা জানাই ছিল। চালাকি নাকি? চট করে সে জবাব দেয়, বিশুদ্ধ জলের কোনো বর্ণ নাই, স্বাদ নাই।
কিন্তু তাতেও খুশি হলেন না স্যার। এমনিতেই রোগ মানুষ, তার ওপর যখন দাঁত খিচোন মনে হয় দাঁত সর্বস্ব শরীর। আর সবচে শকিল ইলশেগুঁড়ির মতো থুতু ছিটোতে থাকে। থুতু ছিটিয়ে স্যার বলেন, আর গন্ধ! বিশুদ্ধ জলে পচা ভাগাড়ের গন্ধ থাকবে বুঝি?
আনু তাড়াতাড়ি যোগ করে, গন্ধও নাই।
বেতের ইশারায় তাকে ফিরে যেতে বললেন স্যার। আবার হাঁক পাড়লেন, নেকস্ট।
এমনি করে পিরিয়ড শেষ হলো। পাশের ছেলেটা বলল, এই স্যার কিছু পড়ায় না ভাই। খালি এই রকম করে।
সুরেন স্যার চলে যেতেই হি–হি করে হাসতে লাগল আনু। এতক্ষণের সব হাসি ফিনিক দিয়ে ছুটছে তার। উলটো বুঝলো পিন্টু। সে পেছনে ঘুরে তাকিয়ে ঘোষণা করল, তোর পাছায় যেদিন বেত লাগাবে স্যার আমিও দাঁত বার করে হাসবো। হ্যাঁ।
শেষ পিরিয়ড। ড্রয়িং স্যার এসে ঢুকলেন। ফর্সা চৌকো চেহারা। সরু করে ছাঁটা গোঁফ। ধবধবে সাদা শার্ট গায়ে। হাসি হাসি মুখ। আনুর খুব ভালো লাগল।
স্যার বসতে বললেন সবাইকে। তারপর বোর্ডে অনেকক্ষণ ধরে একটা বিরাট আমপাতা আঁকলেন—-মাঝখানে ভাঁজ করা, পাতাটা দেখতে হয়েছে ইংরেজি ভি–এর মতো। সুন্দর হলো দেখতে, যেন সত্যি আমপাতা। একবারও মুছলেন না, ভুল হলো না—-একটানে এঁকে ফেললেন। তার হাতের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আনু।
আঁকা শেষ হলে ছেলেদের তিনি বললেন, আমপাতা। চিনতে পারছো?
সমস্বরে সবাই বলে উঠল, হ্যাঁ।
এবার দেখে দেখে আঁকো। যার আগে হবে তার আগে ছুটি।
সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সবাই খাতার পাতায়। স্যার চেয়ারে বসে একটা বই খুলে পড়তে লাগলেন।
দুমিনিটে আঁকা হয়ে গেল আনুর। তখনো কারো হয়নি, তাই খাতাটা প্রথমে সে স্যারের কাছে নিয়ে যাবে, কেমন সংকোচ করল তার। সে চুপ করে বসে রইলো। তারপর দুতিন জন যখন খাতা দেখিয়ে বাড়ি চলে গেল তখন আনু উঠে দাঁড়াল।
স্যার তার খাতা দেখেই মুখ উজ্জ্বল করে বললেন, বাহ্ তোমার আঁকবার হাত ভারী সুন্দর। নতুন ভর্তি হয়েছ? প্রশংসা শুনে লাল হয়ে ওঠে আনু। স্যার কি জানবে, আনু আরো কত কি আঁকে। সালু আপা মিনু আপা সবাইকেও ফুল পাতা না কত কী একে দেয় এমব্রয়ডারী করবার জন্যে। তার নসার ওপর ডি–এম–সি সুতো দিয়ে ওরা যখন নক্সাগুলো বিচিত্র বর্ণে ফুটিয়ে তোলে, এত চমৎকার লাগে দেখতে। মনেই হয় না তার নিজের আঁকা।
দশের মধ্যে সাত নম্বর দিলেন স্যার। তার খাতাটা ক্লাশের সবাইকে দেখালেন। বললেন, তুমি আঁকবে আনু, রং দিয়ে এরপর থেকে আঁকবে। আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব। আচ্ছা।
আনু আজই গিয়ে বাবার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে রং–এর বাকস কিনে আনবে। তার ভারী উৎসাহ লাগে। স্কুল থেকে যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু তাকে ছুটি দিয়ে দেন ড্রয়িং স্যার।
ক্লাশ থেকে বেরিয়ে এসে দেখে, দারোয়ান বিল্টু বারান্দায় ঘণ্টার নিচে বসে বসে ঝিমুচ্ছে, কয়েকটা ক্লাশ ছুটি হয়ে গেছে আগেই, বেঞ্চগুলো খা খা করছে, টিউবওয়েল থেকে একটা ধুলোমাখ; বুড়ো লোক পানি টিপে খাচ্ছে। আনু দেখে জামরুল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে ইয়াসিন সেপাই, তাকে নিয়ে যাবার জন্যে।
বারে, বাবাকে বললাম না, আমি একাই যেতে পারবো। ইয়াসিনকে দেখে আনু বলে ওঠে। তার হাত থেকে বই–খাতা নিয়ে ইয়াসিন হেসে বলে, হাঁ, হাঁ হামি মনে করলাম কে বড়সাবকে নিয়ে আসি।
আনুর ভারী মজা লাগে। বলে, তুমি আমাকে বড় সাব বলো কেন, ইয়াসিন?
আপনি যে বড় সাব আছেন, খোকাবাবু।
যাঃ!
হাঁ হাঁ, আপনি ভি বড় সাব হবেন। থানা মে বসবেন। হামি আপনার ঘোড়া দেখব, হাঁ।
লাল কাঁকর বিছানো টানা সড়ক দিয়ে হাঁটতে থাকে আনু। দুধারে প্রকাণ্ড গেটের মতো আড় হয়ে গাছের মাথাগুলো জড়াজড়ি করে আছে। যতদূর দেখা যায়, ভারী সুন্দর লাগছে। একেবারে শেষ মাথায় কার যেন একটা সাদা বাড়ি ছবির মতো দেখা যাচ্ছে। একটা টমটম চলে গেল টকটক টকাটক করতে করতে। আনু বলে, ইয়াসিন, তুমি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছ?
ইয়াসিন বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে আনুর দিকে।
দূর, তুমি কিছু জানো না।
আপশোস করে ইয়াসিন বলে, আপনার মতো লেখাপড়া করলে তো জানবো খোকাবাবু। হামি তো জাহেল আছি।
হঠাৎ মনে পড়ে যায় আনুর। জিগ্যেস করে, ইয়াসিন, বাবা মফস্বলে চলে গেছে?
হাঁ, দুপুরে তো গেলেন।
মনটা ম্লান হয়ে যায় আনুর। এতক্ষণ এই কথাটা তার মনেই ছিল না। ভাবছিল বাবাকে গিয়ে ইস্কুলের গল্প বলবে! হয়ত আজ রাতে আর ফিরবেন না বাবা।
পিন্টুর কথা মনে হয়। তাকে যদি রাস্তায় ধরে মারে? একটা বুদ্ধি আসে মাথায়। ইয়াসিনকে সে জিগ্যেস করে, তুমি কুস্তি করো?
বাপরে বাপ! হা, করে। কিউ?