ভূগোল পড়তে এত ভালো লাগে আনুর! সালু আপার ভূগোল বই নিয়ে সে পড়ে ফেলেছে। সেখানে আফ্রিকার কথা, এশিয়ার কথা, অগ্নিগিরির নাম কত কি আছে। এখানে খালি রংপুর জেলার ভূগোল। একটুও মজা লাগে না আনুর। পাশের ছেলের বইটা ভাগ করে দেখতে থাকে আনু।
স্যার একটা ছেলেকে বলেন এই তুমি। রিডিং পড়ো। আজ কোথা থেকে পড়াবার কথা ছিল?
খসখস করে সার ক্লাশে পাতা উল্টানোর শব্দ ওঠে। আরেকটা ছেলে বলে, এখান থেকে। স্যার। মহিমপুরের পাশ দিয়া ধরলা নদী প্রবাহিত হইয়াছে।
হ্যাঁ পড়ো।
ছেলেটা দাঁড়িয়েই ছিল। সে তখন আবৃত্তির ঢং–এ গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে পড়তে থাকে।
মহিমপুরের পাশ দিয়া ধরলা নদী প্রবাহিত হইতেছে। এঁ-এঁ-এঁ ধরলা নদী তিস্তা নদীর সহিত মিলিত হইয়াছে। এঁ-এঁ-এঁ-
আনু পাশের ছেলেটার বইয়ে চোখ রেখে মনে মনে পড়ে যায়। পড়তে পড়তে এগিয়ে যায় অনেকদূর। হঠাৎ তার চোখে পড়ে এক জায়গায় লেখা রয়েছে, শীতকালে যখন বাতাস স্বচ্ছ থাকে তখন প্রত্যুষে ধরলা নদীর পাড় হতে উত্তরে হিমালয় পর্বত ও পূর্বে গারো পাহাড় দেখা যায়। হিমালয় পর্বতের বিখ্যাত গিরিশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা মহিপুর হইতে দৃষ্টিগোচর হয়। বইয়ের পাতায় নিবিড় হতে থাকে আনুর মন। কাঞ্চনজঙ্ঘা! এতদিন সে নামই শুনে এসেছে; এখান থেকে দেখা যায় নাকি কাঞ্চনজঙ্ঘা? মনে মনে হিসাব করে দেখে শীত আসতে এখনো দুমাস বাকি। দুমাস তাকে বুক বাধতে হবে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবার জন্যে। বাবাকে গিয়ে আজই এই খবরটা দেবে আনু।
পড়া একবর্ণ আর তার মাথায় যায় না। পাহাড় সে কখনো দেখেনি। পাহাড়ের কল্পনা তার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে আচ্ছন্ন করে রাখে।
এক সময়ে ভূগোলের ক্লাশ শেষ হয়ে যায়। তারপরে আসে স্বাস্থ্যের স্যার। স্বাস্থ্য পড়তে একেবারে জলো লাগে না আনুর। তার হাই ওঠে। হাই তুলতে গিয়ে ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকায়। আর পাশের ছেলেটা তখন বলছিল, এখানে নাকি খুব শাস্তি দেয়। আনু নিজেও হেডমাস্টারের রুমে এক গোছ বেত দেখে এসেছে। সোজা হয়ে শিষ্ট চেহারা করে আনু বসে।
স্বাস্থ্যের স্যার দেখতে রোগা পাতলা, একেবারে একটা কাঠির মতো। মনে হয় বাতাসে হেলে পড়েছেন সামনে। দাঁতগুলো বড় বড় আর বিশ্রী ফাঁক মাঝে মাঝে। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। নাম শুনলো, সুরেন বাবু।
স্যার ক্লাশে ঢুকেই ‘:’ করে বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করলেন। তারপর চেয়ারে বসে দুপা। টেবিলে তুলে এপকেট ওপকেট হাতড়াতে লাগলেন। বেরুলো একটা নস্যির কৌটা আর নাকের ময়লা ভর্তি লালচে ভিজে জবজবে এক ফালি ন্যাকড়া। ফস্ করে নাকে নস্যি দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে নাক টিপে ধরে প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন সুরেন স্যার।
কাণ্ড দেখে প্রায় হেসেই ফেলেছিল আনু। পাশের ছেলেটা বলল, স্যার কিন্তু খুব রাগী। শুনে তাড়াতাড়ি মুখ শুকিয়ে ফেলল আনু। সুরেন স্যার হুংকার দিয়ে ডাকলেন, এইও। ইদিক আয়।
পয়লা বেঞ্চের পয়লা ছেলেটা ঠোঁট কান পর্যন্ত ফাঁক করে দাঁত দেখাল। চশমার ভেতর দিয়ে পিটপিট করে দেখলেন তিনি। তারপর বেত দুলিয়ে আবার হুকুম করলেন, জিহ্বা। আনুর আবার হাসি পাচ্ছিল জিউভা উচ্চারণ শুনে, কিন্তু জোর সামলে নিয়েছে সে।
জিভ দেখে কোনো খুঁত পেলেন না স্যার। বললেন, যা। নেকস্ট। পরের ছেলেটা উঠে গেল।
আনু ফিসফিস করে জিগ্যেস করলো, সবার দাঁত জিভ দেখবে নাকি ভাই?
হ্যাঁ।
রোজ দেখে?
না। প্রত্যেক বিষুৎবারে।
ভাগ্যিস আনু আজ নতুন স্কুলে আসবে বলে নিমডাল দিয়ে কষে দাঁতন করেছিল! জিভেটায় না জানি কত ময়লা পড়ে আছে। জিভ কোনদিন সাফ করেনি আনু। পানু ভাইকে দেখতে সে পিতলের একটা দুলুনি দিয়ে একেক দিন সকালে ময়লা কেটে ফেলতে। আনুর পা কাঁপতে লাগল ভয়ে। পয়লা দিনই মার খাবে নাকি স্যারের হাতে।
এতক্ষণে সেই পিন্টুর পালা এসেছে।
দাঁত।
দাঁত বার করলো পিন্টু। সপাং করে বেত পড়ল তার পাছায়।
হারামজাদা, কচুবনে কচু খাও গিয়ে? মায়ে ভাত দেয় না? দাঁত এত হলদে কেন? কেন?
একবার করে কেন বলেন আর একটা করে বেত লাগান সুরেন স্যার। সঙ্গে সঙ্গে তিড়তিড় করে ওঠে পিন্টু। আড়চোখে সে আনুকে দেখে। আনুর কেন যেন কষ্ট হয়। টিফিনে ঝগড়া। হয়েছে, তবু। চট করে চোখ নামিয়ে নেয় সে। পিন্টুর আর জিভ দেখা হয় না। শেষ একটা বেত লাগিয়ে সুরেন স্যার বলেন, গো ব্যাক। নেস্ট।
এক এক করে এক সময়ে আনুর ডাক পড়ে। সে মাথা নিচু করে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছু বলবার আগেই দাঁত বার করে। সুরেন স্যার বেত দুলিয়ে বলেন, মুখ না তুললে কি পিড়ি পেতে তোমার দাঁত দেখব?
চট করে মুখ তোলে আনু। চোখটা আপনা থেকেই বুজে আসে তার। গম্ভীর একটা আওয়াজ শুনতে পায়, হুঁ। জিভ। বেত লাগাবার সুযোগ না পেয়ে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছে বুঝি স্যারের। জিভ দেখি।
দেখাল আনু।
হঠাৎ সুরেন স্যার চোখ পিটপিট করলেন। মুখের দিকে তাকিয়ে শুধোলেন, এটা কে র্যা? ক্লাশের মনিটর দাঁড়িয়ে বলল, নতুন ভর্তি হয়েছে স্যার।
তোমাকে জিগ্যেস করিনি স্যার। সিট ডাউন।
ম্যাজিকের মতো বসে পড়ল মনিটর ছেলেটা। আনুর পিলেও চমকে গিয়েছিল স্যারের সিট ডাউন চিৎকার শুনে। দরদর করে ঘামতে লাগল সে।
নাম কী?
আনোয়ার হোসেন।
বাবা কী করে?