আনু বুঝতে পারে তার প্রশংসা হচ্ছে। তার লজ্জা হয় অঙ্কটা তার পারা উচিত ছিল। এখন হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় আর্যাটা। মনে পড়ে যায় পঁয়ত্রিশ টাকা মণ হলে এক সেরের দাম হয় চৌদ্দ আনা—-আট সেরের দাম সাত টাকা। কিন্তু বলতে পারে না। ঘনঘন চারদিকে তাকায়। বলবে? না, থাক। ইস, তখন মনেই পড়ছিল না। বাবা খামকাই বলেন, অঙ্কে কাঁচা। বাসায় গিয়ে বলবে বাবাকে, আট সেরের দাম সাত টাকা।
হঠাৎ হেডমাস্টার চিৎকার করে ডাক দেন, বিলটু, বিলটু।
কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুলের দারোয়ান এসে দাঁড়ায়!
একে ক্লাশ ফোরে নিয়ে বসিয়ে দাওগে।
বাবা পেছন থেকে বলেন, ছুটির পরে একা আসতে পারবি বাসায়? না ইয়াসিনকে পাঠিয়ে দেব?
আনু বলে, নাহ্।
বিল্টুর পেছনে ক্লাশের দিকে যেতে থাকে আনু।
০৩. টিফিন পিরিয়ডে একটা ছেলে
টিফিন পিরিয়ডে একটা ছেলে বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে চীনেবাদাম খাচ্ছিল। বাদাম দেখে জিভেয় পানি এসে যায় আনুর। সকালে স্কুলে আসবে বলে দুআনা পয়সা আদায় করেছিল।
ভাবলো, দুপয়সার বাদাম কিনলে মন্দ হয় না।
উঠতে যাবে, তার আগেই ছেলেটা তাকে বলে, বাদাম খাবে?
বলেই একমুঠো বাদাম তুলে দেয় তাকে। আনুর লজ্জা করতে থাকে। সে তো নিজেই কিনতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার কোনো কথাই শোনে না ছেলেটা। তাকে বাদাম দিয়ে বলে, খাও না। আমার মেলা অছে।
অল্পক্ষণের মধ্যে ভাব হয়ে যায় তার সঙ্গে। বেশ নাম—-পিন্টু। তার সঙ্গেই পড়ে। আনু জিগ্যেস করে, তোমার বাবা কি করে?
জুট মার্চেন্ট।
মানে?
বাবার বিরাট পাটগুদাম আছে। কত দূর দূর দেশে বাবা পাট পাঠায়। অস্ট্রেলিয়া, বিলাত, কলকাতা, ঢাকা। তিনটে চারটে মালগাড়ি ভর্তি।
আনুর খুব মজা লাগে। দূর দেশের কথা শুনে সারা গায়ে রোমাঞ্চ কাঁচা হয়ে ফুটে ওঠে। ঘন হয়ে বসে আনু। পিন্টুর হাতে হাত রেখে শুয়ে, তোমার বাবা যায় বিলাতে?
নাহ্।
তখন মনটা নিভে যায় আনুর।
কেন?
বাবা যাবে কেন? রেলগাড়িতে পাট নিয়ে যায়, সেখান থেকে জাহাজে করে চলে যায়। বাবার এখানে কত কাজ।
তবু খুশি হয় না আনু। পিন্টুর বাবা পাট পাঠায় আর নিজে যেতে পারে না? আনু যদি ও রকম হতো তাহলে নিজেই যেত জাহাজে চড়ে। চুপ করে বসে থাকে সে। বসে বসে ভাবতে থাকে। ছবির বইতে দেখেছিল সমুদ্রের জাহাজ, সেই জাহাজ চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
হঠাৎ বলে, আবার জলদস্যুরা জাহাজ আক্রমণ করে, না পিন্টু?
পিন্টু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, দূর, ওসব খালি গল্পের বইয়ে লেখে। সায়েবরা কামান দিয়ে কবে সব জলদস্যুদের মেরে ফেলেছে।
সব মেরে ফেলেছে?
আনুর যে বিশ্বাসই হতে চায় না।
হ্যাঁ, সব। পিন্টু সবজান্তার মতো উত্তর দেয়। বাদামের খোসাগুলো কোল থেকে ঝেড়ে ফেলে। তারপর আচমকা বলে, তোমার চেহারাটা ঠিক মেয়েদের মতো।
যাহ।
কান পর্যন্ত লাল হয়ে যায় আনুর। কি যে বলে পিন্টু! তার চেহারা মেয়েদের মতো কে বলেছে? আয়নায় সে বুঝি দেখে নি? পিন্টু ওর কাঁধে হাত রেখে বলে, তুমি আর আমি বন্ধু, কেমন?
আচ্ছা।
আর কারু বন্ধু হতে পারবে না কিন্তু।
আনু কিছু বলে না। তার কাঁধে ধাক্কা দেয় পিন্টু, কি?
আচ্ছা।
তোমার ক ভাই বোন?
আমরা দুভাই পাঁচ বোন। ভাই বোন সব আমার বড়।
পাঁচ বোন!
পিন্টু তার কথার প্রতিধ্বনি করে। বলে, বিয়ে হয় নি?
না।
তাহলে খুব মজা তোমার বোনের, না?
বলে ফ্যাচফ্যাচ করে হাসতে থাকে পিন্টু। হঠাৎ গা জ্বালা করে আনুর। পিন্টু আবার বলে, ভালোবাসে না তোমার বোনেরা? চিঠি লেখে না?
আনুর ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে পিন্টু।
দূর লজ্জা কি? আমার বোনের চিঠি কত নিয়ে যাই। মাসুদ ভাই আছে, বাবার গদিতে কাজ করে, আমাকে আট আনা করে পয়সা দেয়।
দিক্ গে।
বারে, মেয়েরা তো ঐ জন্যেই সাজে, গালে পাউডার মাখে, ফিতে বাঁধে। দূর বোকা!
হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় আনু। তারপর কেউ কিছু ঠাহর করবার আগেই ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় পিন্টুকে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে, শয়তান। অসভ্য।
মাটিতে পড়েই পিন্টু বোকা হয়ে যায়। একমুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আনুর দিকে। তারপর উঠে গা ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, যা, আজ কিছু বললাম না। এর শোধ নেবো দেখিস। তোর বোনেরা কত সাধু আমি খুব জানি।
অবাক হয়ে যায় আনু। এ একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা তার। কখনো কখনো দারোগার ছেলে বলে তাকে ছেলেরা খ্যাপাতো, তার সঙ্গে মিশতে বারণ করে দিত অনেকে, কিন্তু বোনের কথা তুলে এরকম বিচ্ছিরি কথা কেউ বলেনি। মহিমপুরে এসে অবধি স্কুলে ভর্তি হবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিল সে, ভেবেছিল নতুন বন্ধু করবে, মনটা আনন্দে ভরে ছিল। এই নাকি এখানকার ছেলেরা!
আনুর কান্না পায় ভীষণ। সে ক্লাশে গিয়ে পেছনের বেঞ্চে চুপ করে বসে থাকে। সারাটা ক্লাশ খালি। টিফিনে গেছে সবাই। বুকের মধ্যে হু–হুঁ করতে থাকে তার। আবার ভয় করতে থাকে, পিন্টু যদি তাকে হঠাৎ মার দেয়, লাল খাতায় যদি নাম উঠে যায় আনুর।
.
ঢং ঢং করে টিফিন শেষের ঘণ্টা পড়ে। হুড়মুড় করে ছেলেরা ঢুকতে থাকে ক্লাশে। আনু নড়েচড়ে ঠিক হয়ে বসে। চোখ রাখে একেবারে সোজা ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে! কোনোদিকে তাকাবে না সে। আবছা দেখতে পায়, পিন্টু এসে সেকেণ্ড বেঞ্চে বসলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল তাকে। সঙ্গে সঙ্গে আরো দুজন ছেলে ঘুরে দেখলো আনুকে। আনু বইয়ের পাতায় চোখ। নামালো তাড়াতাড়ি। ওরা কি বলাবলি করছে কে জানে। ভূগোলের স্যার এসে ঢুকলেন। সবাই উঠে দাঁড়াল।