আনুর বুকের মধ্যে ঢিব ঢিব করে ওঠে। ঘাড় কাৎ করে জানায়–হ্যাঁ। বাবা সাইকেলটা বারান্দায় ঠেস দিয়ে রাখেন।
বাবা আগে ঢোকেন হেড মাস্টারের কামরায়। আনু মাথা নিচু করে তার পেছনে পেছনে আসে। দরোজার ভেতরে পা দিয়েই এক হাত তুলে সালাম করে সে ভীত-চোখ তুলে, তারপর কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
মাথায় টাক, গাল থোবড়ানো, জ্বলজ্বলে এক জোড়া চোখ আর গায়ে গেরুয়া রংয়ের চাপকান এ ছাড়া হেড মাস্টারের আর কিছুই চোখে পড়েনি আনুর। দেখেই কেমন ভয় করে। মনে হয়, এখুনি বুঝি ধমক লাগাবেন। কেমন গম্ভীর আর রেগে টং হয়ে আছেন যেন।
বাবা হেড মাস্টারকে কি বলতে লাগলেন তার একবর্ণ কানে গেল না আনুর। তার কান গরম হয়ে উঠেছে, ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে, পা কাঁপছে, প্রস্রাব পাচ্ছে খুব। এখন সদি এক দৌড়ে সে বাসায় চলে যেতে পারত আপাদের কাছে তাহলে যা মজা হতো।
আনু ভয়ে ভয়ে আবার চোখ তোলে। দেয়ালে পৃথিবীর ম্যাপ ঝোলানো। আলমারিতে খাতাপত্র বই সার সার সাজানো। ময়লা কাঁচের ভেতর দিয়েও দেখা যাচ্ছে। আবার দুটো কাঁচ ভাঙা সেখানে পিচবোর্ড কেটে লাগিয়ে দেওয়া। এদিকে একটা লম্বা টেবিলের চারদিকে কয়েকটা হাতাওলা চেয়ার। টেবিলের ওপর চক ন্যাকড়া আর একগোছা বেত রাখা। আমলকির ডাল ভেঙে একটা বেত করা হয়েছে। লিকলিক করছে। ইস্, এইটে দিয়ে মারে নাকি! যা লাগবে!
হেড মাস্টারের ভারী গলার আওয়াজ শুনে চমকেই উঠেছিল আনু।
কাম হিয়ার, মাই বয়।
এক পা এক পা করে কাছে এসে টেবিল ঘেঁষে দাঁড়াল আনু। এক পলক তাকিয়ে দেখল বাবা হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে! আনু ঘামতে লাগল, ইংরেজিতে পড়া ধরবে নাকি? হেড মাস্টার আস্তে আস্তে থেমে থেমে জিগ্যেস করলেন, হোয়াট ইজ ইওর নেম?
মাই নেম ইজ আনোয়ার হোসেন।
হোয়াট ইজ ইওর ফাদারস্ নেম?
মাই ফাদারস নেম ইজ মৌলবি গোলাম হোসেন।
ভেরি গুড।
আনুর ভেতরটা যেন হঠাৎ হালকা হয়ে গেল। না, সে একটিও ভুল করেনি। বাবা বললেন, ওকে আমি নিজে পড়াই দুবেলা। হঠাৎ ট্রান্সফার হয়ে আসতে হলো। এখন ভর্তি না হলে স্কুলে যাবার অভ্যেসটাই ছুটে যাবে। ওখানে ফোরে পড়ত। এখানে ফোরেই অ্যাডমিশন নিক–বইপত্র হয়ত মিলবে না, কিন্তু একটা বছর নষ্ট হয়ে যায় তাহলে।
হেড মাস্টার হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, একমণ চালের দাম ৩৫ টাকা হলে আট সেরের দাম কত?
আনু বিড়বিড় করে হিসেব করতে লাগল মনে মনে। কি যেন আর্যাটা ছিল, কিছুতেই এখন মনে পড়তে চাইছে না তার। ঠকঠক করে পা কাঁপতে লাগল, পিপাসা পেল, তবু মনে হলো না। মাথা নিচু করে সে দাঁড়িয়ে রইলো। বাবার দিকে একবার তাকালো। বাবা তার দিকে তাকিয়ে আছেন। পারল না সে।
হেডমাস্টার আবার জিজ্ঞেস করলেন, একমণ চালের দাম ৩৫ টাকা হলে আট সেরের দাম কত হয়?
পা দিয়ে মেঝে খুঁটতে লাগল আনু।
বাবা হেসে বললেন, অঙ্কে ও বরাবরই একটু কাঁচা। কিরে আনু? ৩৫ টাকা মণ। এক সেরের দাম কত?
তাকে আট দিয়ে গুণ দিলেই বেরিয়ে আসবে।
এক সেরের দাম?
হ্যাঁ।
আচ্ছা থাক।
হেডমাস্টার বাঁচিয়ে দিলেন তাকে। বললেন, এই কবিতাটা পড় দেখি।
আনুকে একটা বই খুলে দিলেন। আনু অঙ্কের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে, অঙ্ক না পারার লজ্জা ঢাকবার জন্যে, খুব মন দিয়ে পড়তে লাগল জোরে জোরে
ধন–ধান্যে পুষ্পে ভরা
আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা।
ও সে স্বপ্ন দিয়ে গড়া সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।
চন্দ্র–সূর্য–গ্রহ–তারা
কোথায় উজল এমন ধারা
কোথায় এমন খেলে তড়িত এমন কালো মেঘে।
ও তার পাখির ডাকে ঘুমিয়ে উঠি পাখির ডাকে জেগে।
এমন স্নিগ্ধ নদী কাহার
কোথায় এমন ধূম্র পাহাড়
কোথায় এমন হরিৎ-ক্ষেত্র আকাশ তলে মেশে।
এমন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে।
থাক, থাক।
হেডমাস্টার হাত তুললেন। আনু তাকিয়ে দেখে বাবা খুব খুশি হয়েছেন। আনু অবাক হয়ে দেখে বাবার চোখে পানি এসে গিয়েছে। চকচক করছে। বড় দেখাচ্ছে তাঁর চোখের কালো তারা। আনু তখন বিহ্বলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে বইটা মুড়ে বুকের কাছে ধরে।
হেডমাস্টার জিগ্যেস করলেন, হরিৎ–ক্ষেত্র মানে কি?
হরিৎ–ক্ষেত্র?
আনু আবার অস্বস্তিবোধ করতে থাকে। হরিৎ–ক্ষেত্র মানে তাহলে কি? হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় পরের লাইনে ধানের কথা আছে। সে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, হরিৎ–ক্ষেত্র মানে ধানের ক্ষেত।
বাবার মুখের হাসিটা নিভে যায়। আনু বুঝতে পারে সে নিশ্চয়ই ভুল করেছে। পরক্ষণে বলে, আমি জানি না।
তুমি খানিকটা ঠিক বলেছ। হেডমাস্টার আশ্বাস দেন তাকে। হরিৎ মানে সবুজ শ্যাম। ধানের ক্ষেতও সবুজ। তবে হরিৎ–ক্ষেত্র মানে সবুজ মাঠ। যখনই নতুন শব্দ পাবে, দেখবে তার মানে জানো না, বাবাকে বা স্কুলে মাস্টার সাহেবকে জিগ্যেস কর। জিগ্যেস করে মানেটা বারবার মুখস্ত করে রাখবে। বুঝলে?
জি।
আর বানানটা খাতায় দশবার লিখে শিখে রাখবে।
আনু ঘাড় কাৎ করে সায় দেয়। হেডমাস্টার বইটা ফেরৎ নেন। বাবাকে বলেন, আচ্ছা। আপনার ছেলে এখন ফোরেই ক্লাশ করতে থাকুক। পরে দেখা যাবে কী হয়। এমনিতে বেশ স্মার্ট বলে মনে হচ্ছে।