দেনা আপা বোতামটা লাগিয়ে।
যা, পারবো না।
সালু আপা তার দিকে না তাকিয়েই ধমক দিয়ে ওঠে। আনু আবার অনুনয় করে, একটা মোটে। দিবি না?
যা, ভাগ, গোলমাল করিস না।
বারে, আজ আমি ইস্কুলে যাবো, তুই জানিস না?
তবু সালু আপা শোনে না। গুন গুন করে আপন মনে সে পেন্সিল দিয়ে রুমালে ফুলের নকশা আঁকতে থাকে। আনু হঠাৎ তার হাত থেকে কাপড়টা টেনে ছুঁড়ে দেয় উঠোনে। বলে, দিবি না তো, দিবি না।
তার ডুকরে ওঠা কান্না শুনে বড় আপা ছুটে আসেন।
কিরে, কি হয়েছে?
সালু আপা আরো জোরে কেঁদে উঠলো তখন। যা মুখে এলো তাই মিথ্যে করে বলল, আনু আমার রুমাল ছিঁড়ে ফেলেছে, আমাকে মেরেছে।
আনু অবাক হয়ে গেল মিথ্যেটা শুনে। প্রতিবাদ করবার মতো বুদ্ধিও তার মাথায় জোগাল না। সে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলো বোতাম-ভাঙা প্যান্টটা হাতে নিয়ে। বড় আপা একবার তাকে দেখলেন, একবার সালুকে দেখলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ছিঃ সালু, আনু আজ ইস্কুলে যাবে। এখন কাঁদাকাটি করতে নেই।
আনু তখন সাহস পেয়ে বলল, আমার বোতামটা লাগিয়ে দিতে বলেছি
দে আমাকে, আমি দিচ্ছি।
বড় আপা আলমারি থেকে কৌটো বার করে তক্ষুণি সূঁচে সুতো পরাতে লাগলেন। লাগিয়ে দিলেন নতুন একটা বোতাম। বোতাম লাগানো শেষ হলে দাঁত দিয়ে সুতো কাটতে কাটতে বললেন, যা আনু, ভাত খেয়ে নে। ভাত হয়ে গেছে।
মা আজ ফেনা-ফেনা ভাত রেঁধেছেন। আনুর জন্যে বার করেছেন ফুল তোলা কাঁচের প্লেট। আনুর আজ খাতির আলাদা। আজ সে স্কুলে যাবে ভর্তি হতে। প্লেটে ভাত বেড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে ভাতের মিষ্টি গন্ধে আর ধোঁয়ায় ভরে গেল আনুর মুখ। বড় আপা চামচে করে ঘি এনে ছড়িয়ে দিলেন ভাতের ওপর। মা শিল–আলুর ভর্তা করেছেন, এক দলা পাতে দিলেন তার। গরমে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। মা এক হাতে আঁচল দিয়ে বাতাস করতে লাগলেন। আনু ফুঁ দিয়ে দিয়ে মাখাতে লাগল। ভাতের সঙ্গে আলু। এক গ্রাস মুখে তুলল। মধুর মতো লাগল।
বড় আপা বললেন, আস্তে খা আনু, এখনো দেরি আছে। পেট ভরে খাবি।
দূর।
আনু আস্তে বলে। খেতে বসে দেখে তার বিশেষ খিদে নেই। আর গলার কাছে কেমন সব আটকে যাচ্ছে।
পেট ভরে না খেলে দেখবি হেড মাস্টারের সামনে গিয়ে সব হজম হয়ে গেছে ভয়ে।
যাঃ। আমার ভয় করে না।
পড়া ধরবে যে। পারবি?
ধরুক না। যা ইচ্ছা ধরুক, আমি সব উত্তর দিয়ে দেব।
মা খুশি হয়ে একবার আনুর দিকে একবার মেয়ের দিকে তাকান। বলেন, না। আনু পড়ায় কত ভালো।
বড় আপা পাবদা মাছের ঝোল বেড়ে দিলেন কাঁসার বাটিতে। নিজের হাতে তুলে দিলেন আনুর পাতে। কুচি কুচি করে কাটা পেঁয়াজ দিয়ে রাধা! সোনার মতো হলুদ রং হয়েছে। ঝাল ঝাল গন্ধ বেরুচ্ছে। জিভে পানি এসে যাচ্ছে। আনু ঢকঢক করে এক গ্লাশ পানি খেল।
এমন সময় বাইরে বাবার গলা শোনা গেল।
আনু, ও আনু।
বড় আপা তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে বললেন, খেতে বসেছে বাবা।
তাড়াতাড়ি করতে বল। ওকে ইস্কুলে দিয়ে আমি আবার মফস্বলে যাবো।
বাবার গলা শুনে আনুর যেন আর এক মুঠো ভাতও গলা দিয়ে নামতে চায় না। বুকটা ধুকধুক করে ওঠে। কি এক অজানা আশঙ্কায় অস্থির লাগে। মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। মা প্রায় চিৎকার করে ওঠেন–কি, তোর খাওয়া হয়ে গেল?
আর খাবো না।
বলতে বলতে হাত ধুয়ে উঠে পড়ে অনু। উঠোনে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন, সাইকেলটা বের করে নিয়েছেন।
আনু এক দৌড়ে ঘরের ভেতর গিয়ে মুখ মোছে, খাতা আর ইংরেজি বাংলা বই নেয়, চট করে একবার আয়নায় মুখ দেখে, তারপর বেরিয়ে আসে। বাবা বলেন, বাহ, জামাটা আনুর গায়ে খুব মানিয়েছে তো? ভাত খেয়েছিস?
হ্যাঁ
মাকে সালাম করলি না?
আনুর লজ্জা লাগে তখন। ধুৎ সে পারবে না। স্কুলে ভর্তি হতে গেলেই বুঝি মাকে সালাম করতে হবে! মহাসংকটে পড়ে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আওয়াজ শুনে মিনু আপাও এসে দাঁড়িয়েছেন বারান্দায়, সে খিলখিল করে হেসে ওঠে।
লজ্জা থেকে মা আনুকে বাঁচিয়ে দেন। ঘোমটা টেনে কাছে এসে আনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ভালো করে লেখাপড়া করিস। কারো সঙ্গে মারামারি করবি না, কেমন?
আনু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বাবার পেছনে বেরিয়ে আসে। সাইকেলের সামনে উঠে বসে এক লাফে। বাবা সাইকেল চালাতে থাকেন। আনু একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে দরোজা ধরে মা বড় আপা মিনু আপা দাঁড়িয়ে আছেন।
দুটো টানা লম্বা ঘর—- ব্যাস, এই হচ্ছে ইস্কুল। সামনে সবুজ ঘাসে ভরা বিরাট মাঠ, তার দুদিকে দুটো গোল পোস্ট রোদে বৃষ্টিতে ভিজে পুড়ে কেমন কালো আর এবড়ো–থেবড়ো হয়ে গেছে? স্কুল ঘরের মাথার ওপর জামরুল আমলকি আর লিচু গাছের বড় বড় ডালগুলো নেমে এসেছে রাশি রাশি পাতা-পত্তর নিয়ে। ছাদ একেবারে ছেয়ে গেছে, টিনগুলোয় সবুজ স্যাঁতলা পরে গেছে। আনু হা করে তাকিয়ে দেখে—এই স্কুল! ক্লাশ বসে গেছে, বড় বড় জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ছেলেদের সার সার মাথা। কেউ নিচু হয়ে বই দেখছে, লিখছে, কেউ সামনে তাকিয়ে আছে, আবার কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে লুকিয়ে। সবাই ক্লাশে, তাই খাঁখাঁ করছে যেন ইস্কুলের মাঠ, রাস্তা, বারান্দা। মাঠের মাঝখানে বাবা নেমে পড়লেন সাইকেল থেকে। আনুও নামলো। বাবা বললেন, অঙ্ক সব ভালো করে মনে করে এসেছিস তো?