সে জিগ্যেস করলো, ভালো আছেন?
তুমি আজকাল আর যাও না যে?
আমার বৃত্তি পরীক্ষা।
বড় আপা চোখ বুজে শুয়ে আছেন। ঘুমিয়ে কি জেগে তা বোঝা যাচ্ছে না। সেদিকে আড় চোখে একবার তাকাল আনু। বিছানার সঙ্গে একেবারে মিশে আছেন। লণ্ঠনের অস্পষ্ট আলোয় আরো শীর্ণ দেখাচ্ছে তাকে। মেজ আপা বললেন, সারাদিন কোথায় থাকিস?
আনু সে কথার জবাব না দিয়ে রান্নাঘরে এলো। সেখানে সেজ আপা মা–র কাছে বসে। আজ তিনি রান্না করছেন। মা চোখ মুছছেন। মা আনুকে দেখে বললেন, নিচু গলায়, যেন শোনাই গেল না, এই এলি! ফতেমা আজ কেমন করছে দেখগে।
ধক করে উঠলো আজ আনুর বুকের ভেতরটা। অসুখটা আবার বেড়েছে? সে কী করবে বুঝতে পারল না। বলল, ডাক্তার আসেনি।
বুলুকে দিয়ে ডাকালাম।
মা আবার চোখ মুছলেন। আনু বেরিয়ে এলো বাইরে। বড় আপার কাছে যেতে পারল না। জিনি সিস্টার বসে আছেন; তার লজ্জা করল কেমন। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। তার দম যে ফুরিয়ে যেতে চাইছে। সে নড়ল না। একটা কুকুর মানুষের বাচ্চার মতো কেঁদে উঠলো কোথায়। বুলু ভাই এসে তার হাত ধরল একটা কথা না বলে। যেন, দুজনে দাঁড়িয়ে আছে, কে আসবে, কার আসবার কথা আছে।
রাতে বড় আপার কাছে এলো আনু। জিনি সিস্টার চলে গেছেন অনেকক্ষণ। সবাই খেতে বসেছে। কেবল মিনু আপা বসে আছেন পায়ের কাছে। আনুর এতক্ষণ আসতে সংকোচ করছিল। কেমন একটা অপরাধ বোধ তাকে দংশে মারছিল। সারাদিন সে বেড়িয়েছে, আর বড় আপার অসুখ বেড়েছে এদিকে একবারও তার মনে হয়নি বাড়ির কথা। মাথা নিচু করে পাশে বসলো সে চোরের মতো। বড় আপা চোখ মেললেন। তখন ব্ৰিতবোধ করল আনু। সে একটা কথা বলতে পারল না। বিছানার চাঁদর খুঁটতে লাগল অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে। বড় আপা তাকে দেখে যেন হঠাৎ খুশি হয়ে উঠলেন, তারপর ফিসফিস করে বললেন, বাবাকে দেখতে যাবি না আনু? বাবাকে আসতে বলিস।
পরদিন ভোরে, সূর্য ওঠার অনেক আগে বড় আপা মারা গেলেন।
সে কাঁদলো না। যেন তার জানাই ছিল সব। মা-র করুণ কান্নার পটভূমিতে সে তন্ময় হয়ে মনের মধ্যে দেখতে লাগল দুপুরের রোদে পুড়ে যাওয়া লাল টকটকে তিস্তা ব্রীজ।
কুড়িগ্রাম ও ঢাকা
জানুয়ারি ১৯৫৭