হাঁটতে থাকে আনু। মাথার ওপরে চড়া রোদ। গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে। কাক ডাকছে। চারদিক খাঁ–খাঁ করছে। টেলিগ্রাফের মেলা তার মাথার ওপরে। বাতাস লেগে মিষ্টি একটা বাজনার মতো শব্দ উঠছে তার থেকে। আনু একটু জিরিয়ে আবার এগোয়। ইস্ কতদূর। ইস্টিশান থেকে ব্রীজটা যতটুকু দেখা গিয়েছিল এখনো ঠিক ততটুকুই লাগছে। ঠিক যেন পাহাড়ের মতো। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে পাহাড় দেখতো আনু, বাবার সঙ্গে। বাবা বলতেন, পাহাড় মনে হয় কাছে, যতদূর যাবি পাহাড়ও ততদূর সরে যাবে।
আর যেন পারে না আনু। কিন্তু কেমন একটা নেশার মতো পেয়ে বসেছে তাকে। ট্রেন, ইস্টিশান, সিগন্যাল, ব্রীজ—- সব যেন তার স্বপ্নের দেশ থেকে আসে। বুকের মধ্যে এমন একটা নিবিড় টান অনুভব করে সে চিরকাল। সে যদি সারাজীবন গাড়িতে গাড়িতে ঘুরতে পারত, হাঁটতে পারত কাঁকর বিছানো প্ল্যাটফরমে, এই রকম রোদে দাঁড়িয়ে টেলিগ্রাম তারে বাতাসের বাজনা শুনতে পারতো। এখানে দুঃখ নেই, অভাব নেই, অসুখ নেই—- শুধু একটা স্থির হয়ে থাকা আনন্দ কেবল। আনু জোরে জোরে হাঁটতে থাকে। ব্রীজটার কাছে সে পৌঁছুবেই।
পায়ের নিচে তেতে উঠেছে নুড়িগুলো। স্লিপার লাফিয়ে লাফিয়ে চলে আনু। দশ বারোটা লাইন এই খানে কাটাকুটি হয়ে ছড়িয়ে গেছে। একটা ধাঁধার মতো লাগছে। একসময়ে সে। পৌঁছে যায় তিস্তা ব্রীজে।
তখন আর গোটা ব্রীজটা দেখা যায় না। তার সমুখে অতিকায় গেটের ঠ্যাংয়ের মতো লোহার বরগা দুদিকে উঠে গেছে। চূড়োটা দেখতে হলে মাথা ঘাড়ের সঙ্গে ঠেকে যায়। লাল টকটকে রংটা সূর্যের হলকা থেকে তৈরি হয়েছে যেন। হাত দেয়া যায় না, হাত পুড়ে যায়। ব্রীজের ওপর রেললাইন চলে গেছে, পাশে পায়ে হাঁটবার পথ। আবার ট্রেন এলে সরে দাঁড়াবার জন্যে মাঝে মাঝে রেলিং দিয়ে ঘিরে দেওয়া গোল একটু জায়গা। ইটের মোটা থামগুলো নেমে গেছে নদীর ভেতরে। যেখানে নেমেছে, তার চারপাশে অবোধ একটা ছেলের মতো পানি ঘুরছে, ঘুরতে ঘুরতে আবার বয়ে যাচ্ছে। একটা খামের নিচে বড় পাথরের চাইয়ের ওপর বসে মাছ ধরছে একটা লোক। মাথায় তার গামছা বাঁধা। ওপর। থেকে তার প্রসারিত হাত দুটো দেখা যায় শুধু।
গুনতে লাগল আনু। আজ সে গুনে দেখল মোট সতেরোটা ত্রিভুজ। একবারে শেষ মাথায় গিয়ে দাঁড়ায় সে। আবার ফিরে আসতে থাকে। পায়ের নিচে নদীটা কী বিশাল, মনে হয়। আকাশটা উপুড় হয়ে পড়েছে, নীলচে একটা রং লেগেছে–তাই কেমন যেন উদাস দেখায়। একটা নৌকা নেই, তাই মানুষ নেই, পাখি নেই খাঁ খাঁ করছে নদীর বুক। দূরে গুমগুম করে একটা শব্দ ওঠে।
আনু তাকিয়ে দেখে ট্রেন আসছে। তক্ষুনি সে রেলিং ঘেরা গোল জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়। শক্ত করে ধরে থাকে। বুক কেঁপে ওঠে। পায়ের নিচে শিরশির করছে, কাঁপনটা বাড়ছে, শব্দটা ভীষণ হচ্ছে। গুমগুম করতে করতে ট্রেনটা তীরের মতো চলে আসছে, বড় হচ্ছে, কাছে। এলো। সড়াৎ সড়াৎ করে আকাশে বাতাসে ঢাকের কাঠি বাজিয়ে বেরিয়ে গেল ট্রেনটা। তখন কাঁপুনিটা কমে গেল। আনু তাকিয়ে দেখে সে ঘেমে গেছে। আনু ভেবে দেখে, ট্রেনটা সে কিছুই দেখতে পায় নি। সে চোখ বন্ধ করে ছিল, খালি শব্দটা শুনেছে, তার গায়ের ওপর দিয়ে ঝড়ের মতো একটা বাতাস বয়ে গেছে।
ইস্টিশানে ফিরে এসে মেল–বাক্সের ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে আনু। চারদিকের বাতাস থেকে একটা ঝিমোনো সুর এসে কানে ফিসফিস করে তার। স্টেশন মাস্টার বাসায় চলে গেছেন। টেলিফোনের বাক্সগুলো চুপ হয়ে গেছে। একটা লোক কোট ভাঁজ করে মাথার নিচে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। কোথায় একটা বাছা কাঁদছে। পানির ট্যাঙ্ক থেকে টপ্ টন্ টন্ টন্ করে চুঁইয়ে পড়ছে পানি।
আস্তে আস্তে কোমল হয়ে এলো রোদটা। ছায়াগুলো লম্বা হলো। রেললাইনের ওপর গিয়ে পড়ল ইস্টিশানের ছায়া। কৃষ্ণচূড়া আর শিমূলের ডালে শোনা গেল পাখিদের কলরব। আবার মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। আবার বেজে উঠতে লাগল টেলিফোনের বাক্স। কুলিরা লণ্ঠনগুলো মাজতে লাগল, কাঁচ পরিষ্কার করল, তেল ভরল। টিভি স্টলে জমে উঠল ভীড়। মহিমপুরে যাবার জন্যে ফুসতে লাগল ইঞ্জিন। হেলতে দুলতে এসে হাজির হলেন গার্ড সাহেব। একটা পান কিনে খেলেন। আনু গিয়ে গাড়িতে উঠল।
মহিমপুরে বাত আটটায় পৌঁছুলো সে। তার ভয় করতে লাগল বাড়ির জন্যে, মার জন্যে। মা কি বলবেন তাকে? সারাদিন সে কোথায় ছিল? সারাদিন বাড়ির কথা একটুও মনে ছিল না তার। সে যেন একটা অন্য মানুষ এই সারাদিন ঘুরে বেরিয়েছে স্কুল পালিয়ে আর যে আনু বাসায় ফিরছে সে যেন মরে ছিল সারাদিন,সন্ধ্যের সময় আবার জেগে উঠেছে। পায়ে পায়ে ফিরে আসে সে। মনে মনে একটা গল্প বানায়। বলবে বৃত্তি পরীক্ষার পড়া বুঝতে গিয়েছিল ক্লাশের একটা ছেলের বাড়িতে। বলবে সেই ছেলেটার প্রাইভেট মাস্টারের কাছে সে আজ থেকে পড়ছে, হেডমাস্টাব বলে দিয়েছেন, তার পয়সা লাগবে না। বলবে হেডমাস্টার তাকে খুব ভালোবাসেন।
বাসায় এসে দেখে জিনি সিস্টার এসেছেন। বড় আপার মাথার কাছে বসে আছেন। পায়ের কাছে বসেছেন মেজ আপা। সালু আপা আর মিনু আপা বারান্দায় চুপ করে বসে আছে অন্ধকারে। ঘর থেকে এক ফালি আলো এসে পড়েছে তাদের মুখে। জিনি সিস্টার তাকে দেখে বললেন, এসো।