সেই অসুখ আর কিছুতে কমল না। জ্বরটা বেড়েই চলল। মাঝখানে আনু একদিন হাসপাতাল থেকে ওধুধ এনে দিয়েছিল। কিস্সু কাজ হয় নি তাতে। বুলু ভাইর মা এসে সবাইকে খুব বকলেন, কী আক্কেল তোমাদের! এমন শক্ত অসুখ, হাসপাতালের ওপর ভরসা করে আছো। পরদিন সকালে বুলু ভাইর সঙ্গে গিয়ে আনু ডাক্তার নিয়ে এলো। হাফপ্যান্ট পরে মাথায় হ্যাঁট চাপিয়ে সাইকেলে করে এলেন ডাক্তার নিয়োগী। পরীক্ষা করে বলে গেলেন টাইফয়েড।
আনু তার সঙ্গে সঙ্গে গেল ডিসপেনসারী। ওষুধ কিনে বাড়ি ফিরল। বলল, ডাক্তার খুব সাবধানে থাকতে বলেছে।
আনু এখন আর খেলতে যায় না, মাছ ধরতে যাওয়াটাও বন্ধ করে দিয়েছে। আজকাল কিছুই যেন ভালো লাগে না তার। বড় আপার অসুখ বলে নয়, সামনে বৃত্তি পরীক্ষা বলেও নয়, এমনিতে। সে নিজেই বুঝতে পারে না, তার কি হয়ে গেছে। মনটা যেন এখানে নেই, কিংবা কোথাও। একটা উড়ে চলার, দূরে চলে যাওয়ার, হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে যেন ভেতর থেকে ঠেলে ঠেলে উঠতে চায়। চারপাশের সমস্ত কিছু এত দূরের মনে হয়–নিস্পৃহতায় ভরে থাকে মন। বড় উদাস মনে হয়।
স্কুলে বসে থাকতেও ভালো লাগে না। একদিন সে স্কুলেই গেল না। বইখাতা নিয়ে বেরুলো, বেরিয়ে গিয়ে নদীর পাড়ে যেখানে খেপাড় হয়, ছোট্ট একটা বাজার মতো যেখানে, সেখানে বসে রইলো। আবার সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে ধরলো রেললাইন। রেললাইন দিয়ে ইস্টিশানে এলো। দুপুর বারোটার ট্রেন আসবে এখন। খবর কাগজ আসবে। একটু পরেই হকার কাগজের বাণ্ডিল নিয়ে বসবে, তাকে খুলবার সময় পর্যন্ত দেবে না, সবাই ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে কাড়াকাড়ি করবে কাগজের জন্যে।
আনু বসে বসে ভিড় দেখতে লাগল। বটগাছের নিচে টমটম তিনটে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘোড়াগুলো মাটিতে পা ঠুকছে, গা কাঁপিয়ে মাছি তাড়াচ্ছে। মিষ্টির দোকানে গ্রামোফন বাজছে। উলিপুরের বাস এসে গেছে। আবার প্যাসেঞ্জার নিয়ে যাবে উলিপুর। ড্রাইভার পানি খাওয়াচ্ছে ইঞ্জিনের বনাট তুলে। আনুর মনে হয়, সেও যদি কোথাও চলে যেতে পারতো তো ভালো হতো। বড় আপা জ্বরের ঘোরে এখন পড়ে আছেন বিছানায়। মার রান্না বোধহয় শেষ হয়নি। সেজ আপা নাইতে গেছেন নিশ্চয়। আনু হাই তোলে। তার এখানেও ভালো লাগছে না। সে উঠতে যাবে, এমন সময় মাটি কাঁপিয়ে, চারদিক চঞ্চল করে ফুসতে ফুসতে ট্রেন এসে দাঁড়াল। হৈহৈ করে লোকেরা নামছে, কুলিরা চিৎকার করছে, বৌ–ছেলেমেয়েরা হাঁটতে পারছে না, তবু দৌচ্ছে খালি গাড়ির দিকে, গেটের কাছে চেকার দাঁড়িয়ে গেছে। আনু গিয়ে গাড়িতে বসলো।
ট্রেন ছেড়ে দিল। সড়াৎ করে বেরিয়ে গেল মহিমপুরের প্ল্যাটফরম, মালগুদাম, স্টেশন মাস্টারের বাড়ি। এ হলো মাঠ, মাঠ শেষে জলা জায়গাটা, তারপর গ্রামের মধ্যে নেমে গেল ট্রেন। আনুর বুকের ভেতরটা ছমছম করে উঠছে, তবু ভালো লাগছে। কোথাও যাবার নেই, তবু সে কোথাও যাচ্ছে। মুখে ঠাণ্ডা বাতাস এসে লাগছে। রোদে ঝকঝকে দেখাচ্ছে আকাশ, মাঠ, ধানক্ষেত, চিল, সাদা বক, মাছরাঙা, পানি সেঁচার চড়ক। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে টোগরাই হাটের ব্রীজ। ব্রীজের নিচে একদিন মাছ ধরতে যাবে আনু। ওখানে ভালো মাছ পাওয়া যায়। বড় আপা বেলেমাছ যা ভালোবাসে। বেলেমাছ ধরে আনবে আনু।
ব্রীজের নিচে কাঁচের মত স্বচ্ছ পানি। পেরিয়ে গিয়ে আবার ধানক্ষেত। রেললাইনের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তাটা। যেন অন্তহীন একটা ফিতে কেবলই খুলে যাচ্ছে। আনুর ঘুম পাচ্ছে খুব। সে কাৎ হয়ে বইখাতা কোলের কাছে নিয়ে শুয়ে পড়ে। তারপর আর কিছু মনে থাকে না।
হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। তাকিয়ে দেখে, আরে তিস্তা এসে গেছে। তিস্তা জংশন। চোখ কচলে তাড়াতাড়ি উঠে বসে সে। এ গাড়ি এখানেই থাকবে। তারপর বিকেলে রংপুরের প্যাসেঞ্জার নিয়ে আবার ফিরে যাবে মহিমপুর। আনু লাফ দিয়ে নামে। কী বিরাট প্ল্যাটফরম তিস্তার। এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটলে পা ধরে আসতে চায়। ঐ শেষমাথায় দুটো বড় বড় কৃষ্ণচূড়া আর শিমুল ফুলের গাছ। তারপরে মাঝে খোলা শেড। ইঞ্জিনের পানি খাবার চোং ঝুলছে মাথার ওপর। আরো এগিয়ে এলে ওজন করবার কল। কলটার ঠিক পাশে নিচু সাইনবোর্ড। তাতে লেখা পার্বতীপুর লাইনে যাইবার জন্য গাড়ি বদল করুন। আরো খানিকটা হাঁটলে ইস্টিশান। ইস্টিশানের দুদিকে মুখ। একদিকে মহিমপুর থেকে গাড়ি এসে দাঁড়ায়, আরেকদিকে রংপুর থেকে, কাউনিয়া থেকে, লালমনিরহাট থেকে। ওয়েটিং রুমে শেতলপাটির টানা পাখা ঝুলছে। স্টেশন মাস্টারের ঘরে মাস্টার সাহেব খবর কাগজ পড়ছেন। এদিকের ঘরে টেলিফোনের সব চৌকো বাক্স বসানো। ইস্টিশান ঘরের পরে ইদারা। লোহার শেকল বাঁধা বালতি থেকে পানি খাচ্ছে যাত্রীরা। তারপর সোজা হেঁটে গেলে একেবারে শেষ মাথায় দোতলা উঁচু ছোট্ট একটা ঘর। গায়ে বড় বড় করে লেখা সাউথ কেবিন। ওখান থেকে সিগন্যাল ওঠায়, নামায়; আবার টেলিফোনে কথা বলে। সেখান থেকে দেখা যায় তিস্তা ব্রীজ। রোদে তার রংটা গোলাপি দেখায় একটা অতিকায় খেলনার মতো লাগে। রংপুর যেতে কতবার আনু ব্রীজটার ওপর দিয়ে গেছে। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখেছে। ব্রীজের ত্রিভুজগুলো গুনবার চেষ্টা করছে। কিন্তু এত জোরে চলে গাড়ি, কোনদিনই সঠিক গুনতে পারেনি। আজ মনে হলো হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় ব্রীজটার কাছে। তার মনের মধ্যে ভারী রোমাঞ্চ হয়। যে ব্রীজের ওপর দিয়ে গাড়ি করে গেছে, সেটাই সে পায়ে হেঁটে পার হবে, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখবে।