আনু রুখে দাঁড়িয়েছিল। ইস, তাকে মারবে এত শস্তা?
আনু উঠে দাঁড়ায়। মেজ আপা আর মা গল্প করতে থাকেন। স্কুলে চাকরি নেয়ার কথা শুনে আনুর কেমন খুশি হচ্ছিল, সেই খুশিটাও ম্লান হয়ে যায়। শোয়ার ঘরে এলে দেখে বড় আপা বসে গেছেন সেলাই নিয়ে। সুঁচে সুতো পরাচ্ছেন। আনু তার বিছানায় গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর একসময় মুখ ফিরিয়ে বলল, তুই মন খারাপ করিস না। আমার ভালো লাগে না।
বড় আপা চকিতে মুখ তুলে তাকান। আনুকে দেখেন। তারপর মুখখানা হাসিমাখা করে সুতো টানতে টানতে বলেন, কই মন খারাপ করি রে? কই?
আনু আর কিছু বলে না। মুখ ফিরিয়ে নেয়। বড় আপা জোর করে হাসতে চেয়েছে। তাই আরো কেমন করুণ লাগছে। তাকিয়ে দেখা যায় না।
সেজ আপা শুনে ঠোঁট উলটে বললেন, ও তো খ্রিষ্টান হয়ে গেছে, তাই ওকে নিয়েছে। মা একটা বোকা, তাই খুশি কত তার। আমাকে কেটে ফেললেও যেতাম না বাবা।
আনুর কেমন সন্দেহ হয় শুনে। তবু সে ধমকে ওঠে, হিংসা হচ্ছে কিনা, তাই।
মনের মধ্যে কেমন করে ওঠে আনুর, সত্যি মেজ আপা খ্রিষ্টান হয়ে গেছে নাকি?
সেজ আপা আবার বললেন। তুই খোঁজ নিয়ে দেখগে, ওদের সব মাস্টারনী খৃষ্টান। একটা মোসলমান নেবে কিনা? কত দায় পড়েছে তাদের।
পরদিন আনু ভোরে মেজ আপাকে দিয়ে এলো স্কুলে। আজ দাই আসবে না। পথে জিগ্যেস করল সে, তুই খ্রিষ্টান হয়ে গেছিস আপা?
কে বলল রে?
এমনি। বল না? ওদের সব মাস্টারনী খ্রিষ্টান?
হ্যাঁ, কি হয়েছে?
তাহলে তোকে নিল কেন? মোসলমান নেয়?
নেবে না কেন? ওদের কত দরকার। এত খ্রিষ্টান পাবে কোথায়? জিনি সিস্টার কত ভালো দেখিস না।
তবু কেমন খচ খচ্ করে ভেতরটা। আর কিছু জিগ্যেস করে না সে। তার যেন মনে হয় সবাই কেমন দূরে সরে যাচ্ছে। মা, বড় আপা, মেজ আপা, সেজ আপা—- সবাই বদলে যাচ্ছেন। কি যেন একেকজনের ভেতরে ভেতরে হয়, আনু তার কিসসু জানতে পারে না। ভারী একা লাগে। কষ্ট হয়। কাউকে বলতে পারে না।
হঠাৎ মাস্টার সাহেবের কথা মনে পড়ে তার। নদীর পাড়ে সেদিন সন্ধ্যেটার ছবি ফিরে আসে। নদীর দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন—-তুমি যখন বড় হবে, তখন বুঝবে। আনুর মনে হয়, সে বড় হয়ে গেছে। সে এখন সব বোঝে। স্কুলের দরোজায় সুবিনয়কে দেখে সে। বলে ওঠে, ঐ তো দারোয়ান। আমি যাই।
মেজ আপা টিনের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে যান।
এখন থেকে রোজ সকালে দাই এসে নিয়ে যায় তাঁকে। কত ভোরে ওঠেন মেজ আপা। তারো আগে মা উঠে রুটি বানাতে থাকে। চা দিয়ে রুটি খেয়ে মেজ আপা চলে যান ইস্কুলে। তারপর চা খেতে বসে সবাই। আনু আজকাল একা চা খায়। কাপটা নিয়ে চলে আসে বারান্দায়। বইগুলো পড়ে থাকে সামনে। রোদ উঠোনময় হয়ে যায়। কাক ডাকতে থাকে। বুলু ভাইদের বাড়িতে কলরব শোনা যায়। একেকদিন আনু খুব মন দিয়ে পড়ে। আবার একেক দিন কী হয় তার কিস্সু ভালো লাগে না। বসে বসে ছিপটা পাকা করে। টোপ বানায়। আজ কোথায় মাছ ধরতে যাবে, তাই ভাবে।
মা চিৎকার করে উঠেন, ওরে তোর চোদ্দ পুরুষ মাঝি ছিল কিনা। তুই ধরবি না তো কে ধরবে? মাছ ধরবি আর বাজারে বিক্রি করবি। লেখাপড়ার কি দরকার?
পালটা জবাব দেয় আনু, আমার বই নেই তো, আমি কি করব! দুখানা বই সাত টাকা লাগে। দিলেই হয়।
মা থামবেন কেন? তিনিও বলে চলেন, সাত টাকার জন্যে তোমার বিদ্যার জাহাজ ভাসে না, না? গরিবের ছেলে লেখাপড়া করে না? চেয়ে চিন্তে বই পড়ে না তারা? বই নাই তো এদ্দিন পরে বললি কেন? খবরদার বলতে পারবি না? যা আমার চোখের সামনে থেকে। যা সব, যা। গুষ্টি দূর হ।
আনু একটু ভয়ই পেয়ে যায়। ভয় পাবে না? মা–র চিৎকার শুনে আপারা পর্যন্ত গুটিগুটি পায়ে সরে পড়েছে। ছিপটা হাতে করে আনু বাইরে এসে দাঁড়ায়। যাক চুলোয়, আজ সে স্কুলেই যাবে না।
পরদিন সাতটা টাকা দেন মেজ আপা। বাসায় এসে সালু আপার কাছে সব শুনেছেন তিনি। আমাকে আগে বলিস নি কেন?
মাথায় হাত দিয়ে একটু পরে বলেন, দাঁড়িয়ে থাকিস না। বই কিনে নিয়ে আয়।
আনু তবু নড়ে না। কালকের রাগ আজ কান্না হয়ে আসতে চাইছে। টাকাগুলো মুঠো করে ধরে রাখে। তখন মেজ আপা বলেন, আচ্ছা, বইয়ের নাম লিখে দে, আমি সুবিনয়কে দিয়ে আনিয়ে নেবখন।
রাতেই বই দুটো এসে যায়। সুবিনয় দিয়ে গেলে আনু বাতির সামনে ধরে নেড়ে চেড়ে দেখে। গন্ধ শোকে নতুন বইয়ের। তক্ষুণি মলাট করে ফেলে। মেজ আপা তার পাশে বসে। বলেন, কি এবার থেকে পড়বি তো?
আনু ঘাড় কাৎ করে। তারপর এদিক ওদিক দেখে ফিসফিস করে মেজ আপাকে বলে, আমাকে একজোড়া স্যাণ্ডেল কিনে দিবি?
১১. সেদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে
সেদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে আনু দেখে, বড় আপা শুয়ে আছেন। মাথার কাছে গেলাশে পানি ঢাকা। দেখে কেমন করে উঠল ভেতরটা। পাশে বসে জিগ্যেস করল, কি হয়েছে? কিছু না।
তার কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর। বলল, জ্বর তো।
সেরে যাবে।
তখন একটু স্বস্তি পেল যেন আনু। না, তেমন কিছু নয়। একটু গা গরম শুধু। বসে বসে সে স্কুলের গল্প করল। বলল, বৃত্তি পরীক্ষা কাছে চলে এসেছে কিনা, তাই এখন ক্লাশে খুব পড়াচ্ছে। হেড মাস্টার তাকে ডেকে নিয়ে, ভালো করে পড়তে বলেছেন। বলেছেন, চেষ্টা করলে আনু বৃত্তি পেয়ে যেতে পারে। বড় আপা তার হাত ধরে উজ্জ্বল মুখ করে বলে উঠলেন, তাহলে বেশ ভালো হয়, নারে? তুই পড়।