দাশবাবু বললেন, কী খোকা! বাবার সঙ্গে দেখা হলো? কেমন আছেন?
হ্যাঁ, ভালো।
বোসো তুমি। ঐখানটায় বোসো।
বলেই আবার কাজে লেগে গেলেন দাশবাবু। একটা কলের গান মেরামত করছেন তিনি। আনু তন্ময় হয়ে তাঁর কাজ করা দেখে। দেখতে দেখতে বেলা পড়ে আসে। বুলু ভাই আসে। মহিমপুরের গাড়ি আটটায় ছাড়ে। বুলু ভাই বলে, টাউন হলে বিচিত্রানুষ্ঠান হচ্ছে। যাবি? গাড়ির আগেই চলে আসব।
আসলে নাম তার ভার্জিনিয়া দাস। সেই থেকে জিনি সিস্টার। আনু শুনেছে মেজ আপার কাছে। মেজ আপার সঙ্গে ভারী ভাব হয়ে গেছে জিনি সিস্টারের। একদিন আনু নিয়ে গিয়েছিল বেড়াতে, বলে দিয়েছিলেন উনি। তারপর থেকে আর কোনদিন না হোক রোববারে মেজ আপা যাবেই। বলে দিয়েছিলেন সবাইকে নিয়ে যেতে। কিন্তু বড় আপা আজকাল বেরোয়ই না। মা বলেন, আমার আবার বেড়ানো? সেজ আপার প্রথম দিনই পছন্দ হয়নি জিনি সিস্টারকে। সেজ আপাও প্রথম দিন গিয়েছিল আনুর সঙ্গে। ফিরে এসে বলে, মাগো। কালো কুষ্টি। তার ওপর আবার চশমা। দেখলে গা জারিয়ে আসে।
মেজ আপা তাকে ধমক দিয়ে উঠেছিলেন, থাক আর তোকে গীত গাইতে হবে না। নিজে যা একখানা সুন্দরী, আয়নায় সুরত দেখিস।
আনু বুঝেই পায় না সেজ আপার এত অপছন্দ কেন। রাতে মেজ আপাকে সে চুপ করে বলে, জানিস, সেজ আপা আরো কী সব খারাপ কথা বলে। মাকে বলেছিল।
বলুকগে। আমার কী বাবা।
রোববারে যাওয়া চাই–ই মেজ আপার। মিশনের মেয়েগুলো ভোরে নেয়ে উঠে ঝকমক করে। পিঠের ওপর ছড়িয়ে দেয় চুল। থালায় করে ফুল নিয়ে গীর্জা ঘরে যায়। বেদি সাজায়। তারপর প্রার্থনা শুরু হয়। জিনি সিসটারের বাবা জন দাস পাদ্রী। তিনি গিয়ে বেদিতে দাঁড়ান। বক্তৃতা দেন। সাধু ভাষায় যখন কথা বলতে থাকেন এত মজা লাগে আনুর।
“একশত মেষের ভিতর নিরানব্বইটি গৃহে ফিরিয়া আসিলেও যে একটি প্রত্যাবর্তন করে নাই, রাখাল বালক তাহার নিমিত্ত গৃহ হইতে অন্ধকার অরণ্যসংকুল পথে বাহির হয়। এবং উচ্চস্বরে রোদন করিয়া ডাকিতে থাকে।“
তারপর বেজে ওঠে অর্গ্যান। গমগমে হয় ওঠে সারা গীর্জাঘর। মনে হয় শাদা দুধে কে যেন সমস্ত ভাসিয়ে ধুয়ে নির্মল করে দিয়ে যাচ্ছে। একসাথে ছেলেমেয়েরা গেয়ে ওঠে—- “শান্তিময় তোমার কোলে ডাকিয়া লও মোরে।” বারবার করে গায়। আবেগে মন্থর গম্ভীর শোনায় সম্মিলিত গলা। সুরের কাঁপনে বুকের মধ্যে গিয়ে পৌঁছায়। কেমন জড়িয়ে আসে সবকিছু। যেন বাস্তব থেকে স্বপ্নের দিকে দেবদূতের আস্তে আস্তে তুলে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ি, ঘর, মানুষ, প্রকৃতি সবকিছু।
মিষ্টি খেতে দেন জিনি সিস্টার। এই গান আর মিষ্টির লোভে আনু রোববারে আসে। সারাক্ষণ মেজ আপা গল্প করতে থাকেন। ঘরের ভেতরে যান। আবার আনুকে বসিয়ে রেখে মেয়েদের ঘরে গিয়ে গল্প করেন। আনু বসে বসে দেখে সামনের চালাঘরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বাইবেলের গল্প বলছেন জিনি সিস্টার। ছবি দেখাচ্ছেন। একটা ছবি আনুর খুব ভালো লেগেছিল। যিশুখৃষ্ট ইদারার পাড়ে একটা মেয়ের কলসি থেকে আজলা ভরে পানি খাচ্ছেন। বেলা দশটা এগারোটা হয়ে গেলে তখন ওরা ফেরে। মা বকেন, তবু যাওয়ার কামাই হয় না। সেজ আপা টিটকিরি কাটেন, তবু মেজ আপার যাওয়া চাইই।
একদিন মেজ আপা বাসায় এসে মাকে বললেন, মা আমি মাস্টারি নিলাম।
শুনে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলেন না মা। তখন মেজ আপা আবার বললেন, বিশদ করে। সর্বজয়া গার্লস স্কুলে ছাত্রীদের পড়বে। এখন মাসে পঁচাত্তর আর দশ টাকা অ্যালাউন্স দেবে! এতক্ষণে আনু বুঝতে পারে এইজন্যে আজ মিশনারী থেকে ফিরে আসবার সময় এত খুশি লাগছিল মেজ আপাকে। সে বলে, জিনি সিস্টার দিয়েছে চাকরি, না?
দেবে কি? আমি চেয়ে নিলাম। বাসায় বসে থেকে করব কি? পড়া তো আর হবে না। তবু দুটো টাকা এলে কাজে লাগবে।
মা জিগ্যেস করলেন, মাইনে কত বললি?
সব মিলিয়ে পঁচাশি।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে তখন তিনি বললেন, দ্যাখো আমার কপাল। মেয়ে হলো ছেলের সমান। এমন মা যেন সাতজন্মে কেউ না পায়।
থাক ও কথা মা।
মেজ আপা মা–র হাতের কাজ কেড়ে নিয়ে সেইটে করতে করতে বলে। আবার বলে, রোজ ভোর সাতটায় যেতে হবে। ফিরতে ফিরতে একটা। দাই এসে নিয়ে যাবে।
সেই সময়ে বড় আপা এলেন ঘরে। মা তার মুখের দিকে তাকালেন। কেমন নিরস কণ্ঠে তাকে শোনালেন, শুনলি, ও মাস্টারী নিয়েছে। মাসে পঁচাশি টাকা মাইনে।
চোখ বড় করে বড় আপা তাকিয়ে থাকেন মেজ আপার দিকে। মুখে একটু পর বলেন, ভালো তো।
তারপর নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে চলে যান। আনু বুঝতে পারে, শুনে বড় আপা কোথায় যেন কষ্ট পেয়েছেন। মা যেন টাকার কথাটা শুনিয়ে শুনিয়েই বললেন বড় আপাকে। অমন করে না বললে কী হতো? আনুর খুব রাগ হয় মা–র ওপর। মা আজকাল কী রকম যেন হয়ে যাচ্ছেন। এই সেদিন স্কুল থেকে বাসায় এসে শোনে বড় আপাকে বকছেন, বাপকে জেলে পাঠালি তাতে শান্তি নাই। এখন আমার হাড়মাংস চিবিয়ে খা, তাহলে পেট ভরবে। যমেও পছন্দ করে না তোকে?
ঘরে ঢুকে দেখে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন বড় আপা। আনু সাহসই পেল না তার কাছে যাবার। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বইখাতা ছুঁড়ে ফেলে বাইরে চলে যাচ্ছিল, মা চেঁচিয়ে উঠলেন, ইস্কুল থেকে এসে কোথায় চললি টো টো করতে। দাঁড়াও আজ তোমার একদিন কী আমার একদিন।