এবার একা গিয়ে সে সবার আগে বসেছিল। কিন্তু কারা এলেন, তাকে পাশে সরতে বলল। সেখান থেকেও শেষ পন্ত ঠেলাঠেলি করে তাকে পেছনের কাতারে ঠেলে দিল। কে ঠেলল, কখন ঠেলল, কিছুই জানে না। যখন সবাই কাতার ঠিক করবার জন্যে দাঁড়িয়েছে তখন আনু দেখে সে পেছনে পড়ে গেছে। চোখে পানি এসে গিয়েছিল তার। সামনে যারা দাঁড়িয়েছে। সবার ওপরে রাগ হচ্ছিল ভীষণ। সে ছোট বলে, কেউ তাকে পাত্তা দেয় না। সে একা বলে, কেউ তাকে তোয়াক্কা করে না। বাবার কথা এত মনে হলো তার। কোথা দিয়ে নামাজ শেষ হয়ে গেল, কিসসু বলতে পারবে না আনু, সারাক্ষণ বাবার কথা মনে পড়ছিল আর বুক ঠেলে ঠেলে কান্না উঠছিল। নামাজ শেষে আনু দেখে চোখে কিছুই দেখতে পারছে না সে। খালি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে সব।
বাসায় এসেই আবার ছুট ইস্টিশানে। মা টিফিনকারীতে সেমাই, পোলাও, গোশত দিয়ে দিয়েছেন। বড় আপা, মেজ আপা আর সেজ আপা তাকে মোট দুটাকা আর মা দুটাকা দিয়েছেন। বুলু ভাই এসে বারবার বলছে, চল, চল, গাড়ি ফেল করবি।
বুলু ভাই ঈদের দিন বেড়াতে যাচ্ছে রংপুর। সিনেমা দেখবে। আনু যাচ্ছে বাবাকে দেখতে। এর মধ্যে দাঁড়িয়েই সেমাই খেতে হলো বুলু ভাইকে। তার একমুহূর্ত সময় নেই। সালু আপা পানি দিতে গিয়ে অর্ধেক গায়ে ফেলে দিল তার। বুলু ভাই লাফিয়ে উঠলেন, এহেহে। দিল তো আমার জামা ভিজিয়ে। মারবো একটা।
গা দিয়ে ফুরফুরে আতরের গন্ধ বেরুচ্ছে। বাইরে বেরিয়ে এসে বুলু ভাই বলে, দাঁড়া আনু, আগে তোর সাথে কোলাকুলি করে নি।
সেদিন বাবার সঙ্গে পাঁচ মিনিটেই দেখা হয়ে গেল। অন্যদিন কত ঝামেলা, আজ ঈদের দিন কিনা, তাই চারদিকে কেমন আনন্দ আর দিল খোলর দরিয়া বয়ে যাচ্ছে। রঙিন জামাকাপড় পরে কত যে লোক এসেছে দেখা করতে। ভিড়ে যেন আর ঠাই হচ্ছে না। কলের গান বাজছে তারস্বরে, দূরে রেস্তোয়। পথের মোড়ে বাদর নাচের ডুগডুগি বাজছে। ঈদের স্পেশাল শো–এর ব্যাপার্টি বেরিয়েছে সিনেমার পোস্টার ঘাড়ে করে। সই সই গাড়ি মোটর রিকশা ছুটে চলেছে। সারা পৃথিবী যেন একতারে অনর্গল খলখল করে হাসছে। রোদ উঠেছে খুব। বাবা দেখা হতেই তার মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে চুমো খেলেন। জিগ্যেস করলেন, কিরে নামাজ পড়েছিস?
হ্যাঁ।
এই জামা কিনলি? বেশ মানিয়েছে। গাড়িতে খুব ভিড় হয়েছিল?
হা। সবাই রংপুরে সিনেমা দেখতে এলো, তাই।
একেবারে ঘেমে গেছিস।
বলতে বলতে বাবা তার মুখ হাত দিয়ে মুছিয়ে দেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করতে থাকেন কে কি পরেছে আজ, কি করছে, ঈদ কেমন হলো। আনু বলে চলে, বড় আপা নীল শাড়িটা পরেছে। কিছুতেই পারব না। মা বলল তারপর। মেজ আপা একটা সবুজ, না কচি কলাপাতার মতো রং মা–র শাড়ি পরেছে। স্যাণ্ডেল কিনেছে নতুন, সাদা, চিকন দুফিতে। সেজ আপা বাক্স খুলে দেখে ওর ব্লাউজের ইস্ত্রী নষ্ট হয়ে গেছে, তাই কী মন খারাপ! আমি যখন আসি তখনো কিছু পরে নি।
আনু টের পায়, বাবা কল্পনার চোখ দিয়ে দেখছেন প্রত্যেককে। হাঁ করে গিলছেন তার কথাগুলো। চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে সব। তখন আনু আরো বিশদ করে বলতে থাকে। এক কথা বারবার করে বলতে থাকে। কিছু বাদ দেয় না। একটা বলতে বলতে আরেকটা মনে পড়ে যায়, খেই হারায়, আবার প্রথম থেকে বলে। বাবা একটুও বাধা দেন না! তন্ময় হয়ে শোনেন। তাঁর চোখে মুখে ব্যথা মেশানো খুশি বেলা শেষের মেঘের মতো ছড়িয়ে থাকে। আস্তে আস্তে মুখটা কেমন দূরে সরে যায়। আনুর মনে হয়, দূর থেকে বাবার একটা বড় ছবি দেখছে আনু! সে আপনমনে বলে চলে। তারপর চুপ করে যায়। বাবা চুপ করে থাকেন। টুপ টুপ টুপ টুপ করে সময় বয়ে যায় যেন। একটা নদীর মতো, বৃষ্টির ফোঁটার মতো, প্যাঁচার চোখ দুটোর মতো। আনু হঠাৎ চোখ তুলে জিগ্যেস করে, তোমাদের বাইরে যেতে দ্যায়?
কেনরে?
ঈদের নামাজ পড়তে।
ভেতরেই মৌলবি সাহেব আসে। এখানে জামাত হয়।
আনু অবাক হয়ে যায় শুনে। হাঁ করে বাবার কথাগুলো শোনে। কল্পনা করতে চেষ্টা করে উঁচু পাঁচিল ঘেরা জেলের মধ্যে ঈদের নামাজটাকে। বাইরে থেকে কয়েকটা গাছের মাথা দেখা যায় শুধু। আনু কল্পনা করে থই পায় না। বাবা একটু পরে বলেন, আনু জেলের মধ্যে একটা আলাদা দুনিয়া। ঠিক আল্লার দুনিয়ার মতো। কে কোথা থেকে এসেছে। নিজের স্বাধীনতা নেই। ওপর থেকে হুকুম হচ্ছে, সেই মোতাবেক কাজ করে চলেছে সবাই। যা দেয় তাই খেতে হয়। যা করতে বলে, তাই। নিজের ইচ্ছার কোনো শক্তি নেই। আবার একদিন হুকুম আসে, ছাড়া পেয়ে যায়। ঠিক দুনিয়াদারির মতো। হায়াৎ মওৎ, রেজেক, কাজকর্ম, সব যেমন আল্লার ইচ্ছায় হয়, তেমনি।
আনু আবছা আবছা বোঝে। বাবা মোহগ্রস্তের মতো কথাগুলো বলে চলেন। কি প্রসঙ্গ, কেন বলা, সে বুঝবে কিনা, কিছুই যেন তিনি ভাবছেন না। কেবল বলতে হবে, এই বোধটা থেকে বলছেন। আনু বুঝতে পারে না; কিন্তু কোথায় যেন কষ্ট হয় তার! মনটা ভারী উদাস হয়ে আসে। সব আনন্দ, হাসি, রোদ, অর্থহীন মনে হয়। যেন সবকিছু তাকে স্পর্শ না করে তার বাইরে বিরাট একটা চাকার মতো ঘুরছে। তার দুঃখ হয় না, কান্না পায় না, বাবা তার হাত ধরে আছেন, সে হাতটাও যেন আর বোঝা যায় না।
বেরিয়ে এসে কেমন শূন্য লাগে ভেতরটা। সে হাঁটতে থাকে। পেট্রোল পাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে মোটরে তেল ভরা দেখে আনু। ঝরঝর শব্দ করে লেখা উঠছে এক–দুই–তিন কতটা পেট্রোল যাচ্ছে। ফুটপাথের ওপর দুটো লোক কোলাকুলি করছে। সিল্কের টুপি মাথায় বাচ্চা একটা ছেলে তার বাবার হাত ধরে কোথায় যাচ্ছে। ছেলেটা হাঁটতে পারছে না ঢিলে, বড়সড় নতুন কাপড়ের ভারে, টলমল করছে। রিকশার খুদে হর্ণ বিকট শব্দ করছে ঘ্যাঁ–পুঁ–ঘ্যাঁ–পুঁ। চাঁদোয়া টানানো রঙ্গিন শরবতের দোকানে ভিড় করে লোক বসেছে। বেঞ্চিতে। হাতে গেলাস নিয়ে একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছে। নেবুর ঘ্রাণ বেরিয়েছে ভারী দাশ কোম্পানিতে গিয়ে বসে আনু। সিনেমা দেখে বুলু ভাই এখানে আসবে। এখানে থাকতে বলে গেছে তাকে। হিন্দুর দোকান। ওদের তো আর ঈদ না। তাই দোকানটা কেমন দেখাচ্ছে আজ। কুর্তি নেই, রঙিন কাগজের মালা নেই, হৈচৈ নেই—-একেবারে ঠাণ্ডা, অন্ধকার।