নাশতা শেষে বাবা এসে নিয়ে গেলেন ওদের কোয়ার্টারে। গেটের সামনে গরুর গাড়ি উপুড় হয়ে আছে ল্যাজ তুলে। গরু দুটো ঘাস খাচ্ছে। আর সেপাইরা ট্রাঙ্ক বিছানা বাক্স টেনে নিয়ে যাচ্ছে ভেতরে।
বাড়ির গন্ধটা ভারী
০২. সকাল বেলা উঠেই আজ গোসল
সকাল বেলা উঠেই আজ গোসল করে নিয়েছে আনু। আজ তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেবেন বাবা! বাবা ভোরে উঠেই থানায় গেছেন, মফস্বল থেকে নাকি খুনের আসামি ধরে এনেছে সেপাইরা, সেই কাজে। বলে গেছেন, দশটার সময় এসে আনুকে নিয়ে যাবেন, সে যেন তৈরি থাকে।
আনুর খুব খুশি লাগছে। এখানে এসে অবধি একটা বন্ধুও তার হয়নি। ছোট দারোগার কোনো ছেলেপুলে নেই; আর জমাদার সাহেব তার বৌ ছেলেমেয়েকে আগেই দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বড় একা দিন কাটছিল আনুর—-পড়ার জন্যে যতটা নয়, তারচেয়ে বেশি বন্ধু পাবার লোভে স্কুলে যাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে সে।
ভোরে গোসল করে উঠেই মাকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে ভাতের জন্যে।
মা, শীগগীর ভাত দাও। দশটা বেজে গেছে।
কোথায় তোর দশটা?
মা বিরক্ত হয়ে ডালের পাতিলে ঘুটনি ঘোরাতে ঘোরাতে বলেন।
হ্যাঁ, তুমি জানো? কত দেরি হয়ে গেল!
আনু অভিমান করে রান্নাঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। বড় আপা তরকারি কুটছিলেন। তিনি মুখ তুলে বলেন, এখন তো মোটে সাড়ে আটটা রে! ইস্কুলে যাবার এত সখ!
বলে হাসেন আর ঘ্যাসঘ্যাস করে তরকারি কোটেন। আনু যে কেন অস্থির হয়েছে স্কুলে। যাবার জন্যে, সেইটে কাউকে বলা যাবে না। সেইটে লুকোবার জন্যে খুব মেজাজ করে আনু। বলে, তোমার মতো নাকি। খালি বাড়িতে বসে থাকব? লেখাপড়া করতে হবে না? এবার হেসে ফেলেন মা। মেয়েকে বলেন, আনুর আজকাল খুব মন হয়েছে লেখাপড়ায়।
হবে না? বড় আপা আবার হাসেন। জানো মা, আনু আমাকে বলেছে ও নাকি রেলের গার্ড হবে। তাই বোধ হয় এত ধুম পড়ার।
বলেছে তোমাকে। না মা মিথ্যে কথা! আমি বলিনি।
বলেই দৌড়ে পালিয়ে যায় আনু। রাগ হয় তার বড় আপার ওপর। কী যে, সব কথা মাকে। বলতে হয় নাকি? এই জন্যে সে রাতে চুপচুপ করে তাকে বলেছে? আর স্কুলে যাবার জন্যে যদি তাড়া করেই থাকে, তাতে এত হাসবার কী আছে?
এইজন্যে একেক সময় দেখতে ইচ্ছে করে না বড় আপাকে। বেশ, আমি গার্ড হবো তাতে ওর কি? গার্ডের চাকরি সবাইক দেয় বুঝি রেলের লোক? গার্ড হতে হলে কত বুদ্ধি, আর লেখাপড়া লাগে তার কী জানে বড় আপা?
সত্যি, মন্দ হয় না গার্ড হলে। কত দেশ যারা যেতআর কী সুন্দর চাকরি। বাবার মতো থানায় গিয়ে চোর–ডাকাতকে হাতকড়া লাগানো নয়, সাইকেল নিয়ে মফস্বলে যাওয়া নয়, ও–রকম বিশ্রী ঘরে কাগজপত্রে উপুড় হয়ে পড়ে লেখা নয়! গার্ডের চাকরি কত মজার! হাতে লাল আর সবুজ নিশান, মুখে বাঁশি, সাদা ধবধবে প্যান্ট, কোট, পেতলের বোতাম লাগানো, পকেটে ঢাকনা, মাথায় চকচকে বারান্দাওয়ালা টুপি। ফুরুর করে বাঁশিতে ফুঁ না। দিলে ড্রাইভারের কোন ক্ষমতাই নেই গাড়ি চালায় তার কাছে ইঞ্জিন থাকলে কী হবে? সারাদিন তাকে ইস্টিশানে ঠায় বসিয়ে রাখতে পারে গার্ড। আবার চলতে চলতে যদি লাল নিশান দেখায় তো থামাতে হবে গাড়ি। গার্ডের চাকরি কী সোজা! বড় আপা খালি হাসতেই পারে। গার্ড হয়ে তাক লাগিয়ে দেবে যেদিন আনু, সেদিন বুঝতে পারবে। বড় আপা, মেজ। আপা, সালু আপা, মিনু আপা, ছোটআপা, মা, বাবা, পানু ভাই সবার সামনে আনু গম্ভীর হয়ে বাঁশি বাজিয়ে নিশান দেখিয়ে চলন্ত গাড়িতে লাফিয়ে উঠবে। ওরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। আনু তাদের দেখবেই না। আনুর কত কাজ। আনু তখন শেষবারের মতো নিশানটা দুলিয়ে ভেতরে গিয়ে খাতা খুলে বসবে। আনু দেখেছে গার্ডেরা খাতা খুলে লেখে গাড়ির মধ্যে। হঠাৎ মন খারাপ হয়ে যায় আনুর। তার বড় হতে এখনো কত দেরি। গার্ড হতে তার দশ বিশ বছর লেগে যাবে। ততদিন তো আর কিছু করার উপায় নেই। ততদিন চুপ করেই থাকতে হবে আর সহ্য করতে হবে ওদের ঠাট্টা, হাসি।
পানু ভাই যদি গার্ড হতো, তাহলেও বেশ হতো। তাহলে আনু পানু ভাইর সঙ্গেই ঘুরে বেড়াতে পারতো। গার্ড না হোক, অন্তত গার্ডের ভাই বলে বাহাদুরি নিতে পারতো। আনু শুনেছে পানু ভাই নাকি আর লেখাপড়া করবে না, চাকুরি খুঁজছে। এবার আনু ঢাকায় পানু ভাইকে চিঠি লিখে দেবে—-ভাইয়া, তুমি গার্ডের চাকরি নিও।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে আনু রাস্তায় দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে থেকে মানুষ দেখে। দেখে, গরুর গাড়ি কাঁচোর কাঁচোর করতে করতে বাজারের দিকে চলেছে। আবার উল্টো দিকে ট্রেন ধরবার জন্যে উলিপুরের বাসটা বুর বুর করে ছুটে চলেছে স্টেশনের দিকে। তাহলে তো এখন নটা বাজে! নটার সময় রোজ উলিপুরের বাসটা তাদের বাসার সামনে দিয়ে যায়।
তাড়াতাড়ি বাসার ভেতরে আসে আনু। কিন্তু আর রান্নাঘরে গিয়ে মাকে তাগাদা করতে সাহস হয় না। কেমন লজ্জাও করে। অথচ তার ইচ্ছা করছে এখুনি সে ছুটে ইস্কুলে গিয়ে বসে।
নিজের ছোট্ট সুটকেশটা খুলে ধোয়া প্যান্ট আর নতুন জামাটা বার করে আনু। জামাটা গেল হপ্তায় কিনে দিয়েছিলেন বাবা। নীল সরু ডোরা কাটা, টেনিস কফ শার্ট। কলারে এখনো কাগজের লেবেল সুতো দিয়ে আটকানো। লেবেলটা ছিঁড়ে ফেলে আনু গায়ে দিল শার্টটা। কাপড়ের নতুন গন্ধ ভুরভুর করে বেরুচ্ছে। ভারী মিষ্টি লাগছে। আর ইস্ত্রী করায় এত মসৃণ। লাগছে যে হাতের তেলো পিছলে যায়। প্যান্টটা খুলে দেখে একটা বোম ভাঙা। পাশের ঘরে সালু আপা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। রুমালের ফুল আঁকছিল। তাকে গিয়ে ধরলো আনু।