আজ একটা মাছ ধরতে পারেনি সে, ছিপটা গেছে। মারামারি করে মাথা ফাটিয়েছে, তবু একটুও মন খারাপ করে না আনুর। যেন ভারী আশ্চর্য কিছু পেয়ে গেছে সে আজ। খুব বাহাদুর মনে হয় নিজেকে, ভিতরটা ফুরফুর করে ওঠে।
সুবিনয়, যা তো বাবা, একে বাসায় দিয়ে আয়
আনু বাইরে আসে। আকাশটা লাল হয়ে গেছে। তকতকে উঠোনটা আরো বড় দেখাচ্ছে। লাইব্রেরী ঘরে লোকেরা বসে বই পত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছে। কয়েকটা মেয়ে ধপধপে ধোঁয়া কাপড় পরে, চুল টানটান করে বেঁধে গীর্জা ঘর ঝাড় দিচ্ছে। আবার কয়েকজন বাগানে পানি দিচ্ছে। ঠাণ্ডা ঝিরঝির বাতাস বইছে উত্তর থেকে। ফুল গাছগুলো ছবির মতো আঁকা হয়ে আছে যেন। টিনের বড় গেটটা পর্যন্ত এলেন জিনি সিস্টার। হঠাৎ বললেন, শোনো, তোমার বোনদের স্কুলে আসতে বোলো কাল থেকে। মা–কে বোলো আমি ফ্রি করে দেব। বোলো, জিনি সিস্টার বলে দিয়েছে। কেমন?
কাল আমাকে চারা দেবেন। আমি আসবো?
আচ্ছা, এসো।
বাড়ির দরোজায় মেজ আপার সঙ্গে দেখা। দরোজা ভেজিয়ে রাস্তা দেখছিলেন গাল পেতে। সুবিনয়ের সঙ্গে আনুকে দেখে চমকে উঠলেন তিনি।
এ–কী? তোর কি হয়েছে আনু?
কিছু না। ফুটবল খেলতে গিয়ে—-
হঠাৎ তার খেয়াল হয় সুবিনয় পাশে দাঁড়িয়ে : সে তাকে বললো, তুমি যাও দারোয়ান। এটা আমার বাসা।
সে চলে গেলে আনু সোৎসাহে বলতে থাকে, ফুটবল খেলতে গিয়ে মাথায় চোট লেগেছিল। জিনি সিস্টার, সর্বজয়া স্কুলের বড়দিমনি, ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিয়েছে। সালু আপা আর মিনু আপার ফুল ফ্রি করে দেবে বলছে, আমাকে ফুলের চারা দেবে, দেখো।
এসব কিছুই শোনেন না মেজ আপা। তার মাথার ব্যাণ্ডেজে হাত রেখে বলেন, শীগগীর চল তুই ভেতরে। মা দেখলে! ইস্, এত দুষ্ট হয়েছিস তুই।
আনুর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে বলে, যাও, যাও। মা কী বলবে? আমি ইচ্ছে করে মাথা ফাটিয়েছি, না? আর ওদের ফুল ফ্রি হয়ে গেল, সেটা কী? আমাকে বকবে, এঃ।
.
তারপর থেকে এমন হলো প্রায় রোজ যেত জিনি সিসটারের কাছে আনু। ফুলের চারা এনে লাগিয়েছে সে। গোলাপের দুটো কলমও এনেছে। বারান্দার পাশে আনুর বাগানটা এখন কী সুন্দর হয়েছে। গোলাপ যেদিন ধরবে সেদিন হবে আসল মজা। সেদিন একটা ফুল চুরি করে সেজ আপা খোঁপায় দিয়েছিল, আনু কী রাগ করলো। মা বললেন, একরকম করলে তোর সব গাছ আমি কেটে ফেলব। মানুষ হয়েছে না জানোয়ার হয়েছে একটা।
আজকাল কী হয়েছে, কথায় কথায় মা বিরক্ত হয়ে ওঠেন, চাঁচাতে থাকেন, গাল পাড়েন। সারাক্ষণ মুখটা কালো হয়ে থাকে। আনু কিসসু ভেবে পায় না। এ রকম হয়ে গেছেন কেন উনি? তার খুব রাগ হয় একেক সময়। মার সঙ্গে কথাই বলে না সে সারাদিন। আবার রাতে এসে মাথার কাছে বসেন। আস্তে আস্তে ডাকেন, ওঠ, বাবা আমার। ভাত খাবি না?
তখন আর কিসসু মনে থাকে না আনুর। তখন সে আবার আগের মতো হয়ে যায়। মার হাত জড়িয়ে ধরে আরো কিছুক্ষণ পড়ে থাকে। মা বলেন, তুই রোজ ভাত না খেয়ে ঘুমোলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে যে। ওঠ। কাল থেকে সন্ধ্যার সময় ভাত বেঁধে দেব। ওঠ আনু।
সালু আপা মিনু আপা আবার স্কুলে যায়। ওদের একটা বছর নষ্ট হয়ে গেল। বাবাকে গিয়ে যখন সেদিন আনু বলল ওরা আবার স্কুলে যাচ্ছে, কী খুশি হলেন তিনি। লেখাপড়ার কথা শুনলে, এত খুশি হন বাবা। মুখটা সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করে ওঠে। আনু আরো ভালো করে লেখাপড়া করবে। এবার যদি সে ফার্স্ট হতে পারে তো স্কা একটা কাণ্ড হয়। বাবা শুনে প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাইবেন না। তখন আনু তাকে প্রোগ্রেস রিপোর্ট দেখাবে। বলবে, বৃত্তি পরীক্ষা দেবে। বৃত্তি পেলে কত ভালো হয়। এক পয়সা লাগবে না পড়তে, আবার মাস মাস ছটাকা করে পাবে। ছটাকায় কত কী করা যায়। আনু একজোড়া স্যাণ্ডেল কিনবে। খালি পায়ে তার এত লজ্জা করে স্কুলে। কিন্তু কোনদিন সে কথা বাসায় বলে না। সে তো বোঝে, কী কষ্টে সংসার চালাচ্ছেন মা। পানু ভাইর জন্যে টাকা দিল রেল কোম্পানি। সেই টাকা দিয়ে আপাদের বিয়ে দেবার কথা। তা থেকেও এখন পাঁচ টাকা দশ টাকা করে কমছে। এদিকে মামা প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখছেন টাকা চেয়ে। আজকাল মামার চিঠি মা পড়েনও না, জবাবও দেন না। মামার ওপরে ভীষণ রাগ হয় আনুর। তারচেয়ে মনিরের বাবা অনেক ভালো। রোজার ঈদে একশ টাকা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু মা যেন কেমন! টাকা সই করে রাখলেন কিন্তু কদিন ধরে বারবার বলতে লাগলেন, না নিলেই হতো। এখন বড়লোকী দেখাচ্ছে।
সেই টাকা দিয়ে ঈদে নতুন জামা হলো। আনু একাই নামাজ পড়তে গিয়েছিল মাঠে। বাবা থাকতে ভোর বেলায় তোপ পড়বার আগে, অনেক আগে আনুকে নিয়ে মাঠে হাজির হতেন। বসতেন একেবারে প্রথম সারিতে। হাফেজ সাহেবের ঠিক পেছনে। তারপর একটা তোপ পড়তো, তার আধঘন্টা পরে আবার একটা। আবার যখন পড়তো, তখন সবাই কাতার বেঁধে দাঁড়াত। লোকেরা দৌড়ে দৌড়ে পুকুর থেকে ঝপাঝপ ওজু করে আসতো। গরিবদের জন্যে কাগজের রঙ্গিন টুপি বিক্রি হতো একআনা করে; সেই টুপি কিনবার জন্যে কাড়াকাড়ি লেগে যেত। জং পড়া পানির খালি ট্যাঙ্কে কাক ডাকতো কা–কা করে। হাফেজ সাহেব পাগড়ি পরে সামনে এসে দাঁড়াতেন তখন। একটি লোক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নামাজের নিয়ত বলে দিত। আবার বলত, যারা মনে রাখতে পারবেন না, তারা বলবেন, ইমামের যে নিয়ত আমারো সেই নিয়ত, আল্লাহ আকবর। যা হাসি পেত শুনে আনুর।